Archive for the ‘বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮ – ১৯৭৪)’ Category

>…
কী ভালো আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায়
কেমন করে বলি।
কী নির্মল নীল এই আকাশ, কী অসহ্য সুন্দর,
যেন গুণীর কণ্ঠের অবাধ উন্মুক্ত তান
দিগন্ত থেকে দিগন্তে;
কী ভালো আমার লাগলো এই আকাশের দিকে তাকিয়ে,
চারদিক সবুজ পাহাড়ে আঁকাবাঁকা, কুয়াশার ধোঁয়াটে,
মাঝখানে চিল্কা উঠছে ঝিলকিয়ে।

তুমি কাছে এলে, একটু বসলে, তারপর গেলে ওদিকে,
ইস্টেশনে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, তা-ই দেখতে।
গাড়ি চলে গেলো ! কী ভালো তোমাকে বাসি,
কেমন করে বলি।

আকাশ সূর্যের বন্যা, তাকানো যায় না
গোরুগুলো একমনে ঘাস ছিঁড়ছে, কী শান্ত !
তুমি কি কখনো ভেবেছিলে এই হ্রদের ধারে ধারে আমরা পাবো
যা এতদিন পাইনি ?

রূপোলি জল শুয়ে-শুয়ে স্বপ্ন দেখছে, সমস্ত আকাশ
নীলের স্রোতে ঝরে পড়ছে তার বুকের উপর
সূর্যের চুম্বনে। -এখানে জ্বলে উঠবে অপরূপ ইন্দ্রধনু
তোমার আর আমার রক্তের সমুদ্রকে ঘিরে
কখনো কি ভেবেছিলে ?

কাল চিল্কায় নৌকোয় যেতে যেতে আমরা দেখেছিলাম
দুটো প্রজাপতি কতদূর থেকে উড়ে আসছে
জলের উপর দিয়ে। -কী দুঃসাহস ! তুমি হেসেছিলে, আর আমার
কী ভালো লেগেছিলো।
তোমার সেই উজ্জ্বল অপরূপ সুখ। দ্যাখো দ্যাখো,
কেমন নীল এই আকাশ আর তোমার চোখে
কাঁপছে কত আকাশ, কত মৃত্যু, কত নতুন জন্ম
কেমন করে বলি।

>…

কোথায় চলেছো ? এদিকে এসো না! দুটো কথা শোনো দিকি,
এই নাও-এই চক্চকে, ছোটো, নতুন রূপোর সিকি।
ছোকানুর কাছে দুটো আনি আছে , তোমারে দেবো গো তা-ও,
আমাদের যদি তোমার সঙ্গে নৌকায় তুলে’ নাও।
নৌকা তোমার ঘাটে বাঁধা আছে-যাবে কি অনেক দূরে ?
পায়ে পড়ি, মাঝি, সাথে নিয়ে চলো মোরে আর ছোকানুরে।
আমারে চেনো না ? মোর নাম খোকা, ছোকানু আমার বোন।
তোমার সঙ্গে বেড়াবো আমরা মেঘনা-পদ্মা-শোন্।
দিদি মোরে ডাকে গোবিন্দচাঁদ, মা ডাকে চাঁদের আলো,
মাথা খাও, মাঝি, কথা রাখো! তুমি লক্ষী, মিষ্টি, ভালো!
বাবা বলেছেন, বড় হ’য়ে আমি হব বাঙলার লাট,
তখন তোমাকে দিয়ে দেবো মোর ছেলেবেলাকার খাট।
চুপি-চুপি বলি, ঘুমিয়ে আছে মা, দিদি গেছে ইস্কুলে,
এই ফাঁকে মোরে-আর ছোকানুরে-নৌকায় লও তুলে।

কোনো ভয় নেই- বাবার বকুনি তোমাকে হবে না খেতে
যত দোষ সব, আমার-না, আমি একা ল’ব মাথা পেতে।
নৌকা তোমার ডুবে যাবে নাকো, মোরা বেশি ভারি নই,
কিচ্ছু জিনিস নেবো না সঙ্গে কেবল ঝন্টু বই।
চমকালে কেন! ঝন্টু পুতুল, ঝন্টু মানুষ নয়,
একা ফেলে গেলে, ছোকানুরে ভেবে কাঁদিবে ও নিশ্চয়।
অনেক রঙের পাল আছে, মাঝি ? বাদামী ? সোনালী ? লাল ?
সবুজও ? তা হলে সেটা দাও আজ, সোনালীটা দিয়ো কাল।
সবগুলো নদী দেখাবে কিন্তু। আগে চলো পদ্মায়,
দুপুরের রোদে রূপো ঝল্মল সাদা জল উছলায়।
শুয়ে’ শুয়ে’-মোরা দেখিব আকাশ- আকাশ ম-স্ত বড়,
পৃথিবীর যত নীল রঙ-সব সেখানে করেছে জড়ো !
মায়ের পূজোর ঘরটির মত, একটু ময়লা নাই,
আকাশেরে কে যে ধোয় বারবার, তুমি কি জানো তা ভাই ?
কালো কালো পাখী বাঁকা ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলে যায় দূরে,
উঁচু থেকে ওরা দেখিতে কি পায় মোরে আর ছোকানুরে ?
রূপোর নদীতে রূপোর ইলিশ- চোখ ঝল্সানো আঁশ,
ওখানে দ্যাখো না- জালে বেঁধে জেলে তুলিয়াছে একরাশ।
ওটা চর বুঝি ? একটু রাখো না, এ তো ভারি সুন্দর !
এ যেন নতুন কার্পেট বোনা ! এই পদ্মার চর ?

ছোকানু, চল রে চান ক’রে আসি দিয়ে সাত-শোটা ডুব,
ঝাঁপায়ে-দাপায়ে টলটলে জলে নাইতে ফূর্তি খুব।
ইলিশ কিনলে ? -আঃ, বেশ বেশ, তুমি খুব ভালো, মাঝি।
উনুন ধরাও, ছোকানু দেখাক রান্নার কারসাজি।
খাওয়া হ’লো শেষ, আবার চলেছি, দুলছে ছোট্ট নাও,
হালকা নরম হাওয়ায় তোমার লাল পাল তুলে দাও।
আমরা দু’জন দেখি ব’সে-ব’সে আকাশ কত না নীল,
ছোটো পাখি আরো ছোটো হ’য়ে যায়- আকাশের মুখে তিল।
সারাদিন গেলো, সূর্য লুকোলো জলের তলার ঘরে,
সোনা হ’য়ে জ্ব’লে পদ্মার জল কালো হ’লো তার পরে।
সন্ধ্যার বুকে তারা ফুটে ওঠে- এবার নামাও পাল,
গান ধরো, মাঝি ; জলের শব্দ ঝুপঝুপ দেবে তাল।
ছোকানুর চোখ ঘুমে ঢুলে আসে- আমি ঠিক জেগে আছি,
গান গাওয়া হ’লে আমায় অনেক গল্প বলবে, মাঝি ?
শুনতে-শুনতে আমিও ঘুমোই বিছানা বালিশ বিনা-
মাঝি, তুমি দেখো ছোকানুরে, ভাই, ও বড়োই ভিতু কিনা।
আমার জন্যে কিচ্ছু ভেবো না, আমি তো বড়োই প্রায়,
ঝড় এলে ডেকো আমারে- ছোকানু যেন সুখে ঘুম যায়।

>…

সোনালি আপেল, তুমি কেন আছ ? চুমো খাওয়া হাসির কৌটোয়
দাঁতের আভায় জ্বলা লাল ঠোঁটে বাতাস রাঙাবে ?
ঠাণ্ডা, আঁটো, কঠিন কোনারকের বৈকুণ্ঠ জাগাবে
অপ্সরীর স্তনে ভরা অন্ধকার হাতের মুঠোয় ?

এত, তবু তোমার আরম্ভ মাত্র | হেমন্তের যেন অন্ত নেই |
গন্ধ, রস, স্নিগ্ধতা জড়িয়ে থাকে এমনকি উন্মুখ নিচোলে |
তৃপ্তির পরেও দেখি আরও বাকি, এবং ফুরালে
থামে না পুলক, পুষ্টি, উপকার | কিন্তু শুধু এই ?

তা-ই ভেবে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে | কিন্তু মাঝে মাঝে
আসে ভারি-চোখের দু-এক জন কামাতুর, যারা
থালা, ডালা, কাননের ছদ্মবেশ সব ভাঁজে-ভাঁজে

ছাঁড়ে ফেলে, নিজেরা তোমার মধ্যে অদ্ভুত আলোতে
হ’য়ে ওঠে আকাশ, অরণ্য আর আকাশের তারা —
যা দেখে, হঠাত্ কেঁপে, আমাদেরও ইচ্ছে করে অন্য কিছু হ’তে

>

আকাশে আষাঢ় এলো; বাংলাদেশ বর্ষায় বিহবল।
মেঘবর্ণ মেঘনার তীরে-তীরে নারিকেলসারি
বৃষ্টিতে ধূমল; পদ্মাপ্রান্তে শতাব্দীর রাজবাড়ি
বিলুপ্তির প্রত্যাশায় দৃশ্যপট-সম অচঞ্চল।

মধ্যরাত্রি; মেঘ-ঘন অন্ধকার; দুরন্ত উচ্ছল
আবর্তে কুটিল নদী; তীর-তীব্র বেগে দেয় পাড়ি
ছোটে নৌকাগুলি; প্রানপনে ফেলে জাল,টানে দড়ি
অর্ধনগ্ন যারা,তারা খাদ্যহীন,খাদ্যের সম্বল।

রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে
জলের উজ্জ্বল শষ্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব,
নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়।
তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে
ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানীর গিন্নির ভাঁড়ার
সরস সর্ষের ঝাঁজে।এলো বর্ষা,ইলিশ -উৎসব।