Archive for the ‘নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (১৯২৪ – )’ Category

>…

সিতাংশু, আমাকে তুই যতো কিছু বলতে চাস, বল।
যতো কথা বলতে চাস, বল।
অথবা একটাও কথা বলিসনে, তুই
বলতে দে আমাকে তোর কথা।
সিতাংশু, আমি যে তোর সমস্ত কথাই জেনে গেছি।
আমি জেনে গেছি।

কী বলবি আমাকে তুই, সিতাংশু ? বলবি যে,
ঘরের ভিতরে তোর শান্তি নেই, তোর
শান্তি নেই, তোর
ঘরের ভিতরে বড়ো অন্ধকার, বড়ো
অন্ধকার, বড়ো
বেশি অন্ধকার তোর ঘরের ভিতরে।
(সিতাংশু, আমি যে তোর সমস্ত কথাই জেনে গেছি।
আমি জেনে গেছি।)

কী বলবি আমাকে তুই, সিতাংশু ? বলবি যে,
দৃশ্যের সংসার থেকে তুই
(সংসারের যাবতীয় অস্থির দৃশ্যের থেকে তুই)
স্থিরতর কোনো-এক দৃশ্যে যেতে গিয়ে
গিয়েছিস স্থির এক দৃশ্যহীনতায়।
অনন্ত রাত্রির ঠাণ্ডা নিদারুণ দৃশ্যহীনতায়।
দৃশ্যের বাহিরে তোর ঘরে।

জানিরে, সিতাংশু, তোর ঘরের চরিত্র আমি জানি।
ওখানে অনেক কষ্টে শোয়া চলে, কোনোক্রমে দাঁড়ানো চলে না।
ও-ঘরে জানালা নেই, আর
ও-ঘরে জানালা নেই, আর
মাথার দু’ইঞ্চি মাত্র উর্ধ্বে ছাত। মেঝে
স্যাঁতস্যাঁতে। দরোজা নেই। একটাও দরোজা নেই। তোর
চারদিকে কাঠের দেয়াল।
এবং দেয়ালে নেই ঈশ্বরের ছবি।
এবং দেয়ালে নেই শয়তানের ছবি।
(তা যদি থাকত, তবে ঈশ্বরের ছবির অভাব
ভুলে যাওয়া যেত।) নেই, তা-ও নেই তোর
নির্বিকার ঘরের ভিতরে।

না, আমি যাব না তোর ঘরের ভিতরে।
যাব না, সিতাংশু, আমি কিছুতে যাব না।
যেখানে ঈশ্বর নেই, যেখানে শয়তান নেই, কোনো-কিছু নেই,
প্রেম নেই, ঘৃণা নেই, সেখানে যাবো না।
যাব না, যেহেতু আমি মূর্তিহীন ঈশ্বরের থেকে
দৃশ্যমান শয়তানের মুখশ্রী এখনো ভালোবাসি।
না, আমি যাব না তোর ঘরের ভিতরে।

সিতাংশু, তুই-ই বা কেন গেলি ?
অস্থির দৃশ্যের থেকে কেন গেলি তুই
স্থির নির্বিকার ওই দৃশ্যহীনতায় ?
সিতাংশু, আমি যে তোর সমস্ত কথাই জেনে গেছি।
আমি জেনে গেছি।
দৃশ্যের ভিতর থেকে দৃশ্যের বাহিরে
প্রেম-ঘৃণা-রক্ত থেকে প্রেম-ঘৃণা-রক্তের বাহিরে
গিয়ে তোর শান্তি নেই, তোর
শান্তি নেই, তোর
ঘরের ভিতরে বড়ো অন্ধকার, বড়ো
অন্ধকার, বড়ো
বেশি অন্ধকার তোর ঘরের ভিতরে।

>


ক্রমে স্পষ্ট হয় সব । কে সিংহ, কুকুর, হাতি, সার্কাসের ঘোড়া ;
কে টিয়া, চন্দনা, কংবা হাঙর কুমির ;
বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে এসে কলকাতার ভীড়
ঠেলে কে সাঁতার কাটে ; কে ধর্মতলায়
পাঞ্জাবির হাতা নেড়ে উড়ে যেতে চায়
হঠাত্ আকাশে । যেন একে একে সবগুলি অভ্যাসের ফোড়া
ফেটে গেলে ঠিক
বিকেলে তিন পা হেঁটে চিনে নেওয়া যায়
কে ব্যাঘ্র, বিড়াল, হাঁস, ঝুঁটি-কাকাতুয়া ;
এবং কে শাশ্বত নাবিক ।
ক্রমে স্পষ্ট হয় সব । সব কিছু জানা গেল, এমন ধারণা
নিয়ে ঘরে ফিরে গিয়ে ঘুমোনো সহজ হয়, আর
ঘুমের একটু আগে মনে হয়, দারুণ বাহার
খুলেছে রাস্তায়-ঘাটে । সবগুলি ফোড়া
ফাটিয়ে গণ্ডার, বাঘ, সার্কাসের ঘোড়া
ছুটে যায় । মনে হয় ভিড়ের ভিতরে কেউ “হুশ্”
ব’লে উঠেছিল ; তাই ডানা ঝপটিয়ে
নিখিল শূণ্যের দিকে উড়ে চ’লে গেল
কয়েকটি সুন্দর মানুষ ।

>


না, সে নয় । অন্য কেউ এসেছিল । ঘুমো তুই ঘুমো ।
এখনো রয়েছে রাত্রি, রোদ্দুরে চুমো
লাগেনি শিশিরে । ওরে বোকা,
আকাশে ফোটেনি আলো, দরজায় এখনো তার টোকা
পড়েনি । টগর-বেলা-গন্ধরাজ-জুঁই
সবাই ঘুমিয়ে আছে, তুই
জাগিসনে আর । তোর বরণডালার মালাগাছি
দে আমাকে, আমি জেগে আছি ।
না রে মেয়ে, নারে বোকা মেয়ে,
আমি ঘুমোবো না । আমি নির্জন পথের দিকে চেয়ে
এমন জেগেছি কত রাত,
এমন অনেক ব্যথা-আকাঙ্ক্ষার দাঁত
ছিঁড়েছে আমাকে । তুই ঘুমো দেখি, শান্ত হ’য়ে ঘুমো ।
শিশিরে লাগেনি তার চুমো,
বাতাসে ওঠেনি তার গান ।
                 ওরে বোকা,
এখনও রয়েছে রাত্রি, দরজায় পড়েনি তার টোকা ।

>


“বাতাসি ! বাতাসি !”—লোকটা ভয়ংকর চেঁচাতে চেঁচাতে
গুমটির পিছন দিকে ছুটে গেল ।
ধাবিত ট্রেনের থেকে এই দৃশ্য চকিতে দেখলুম ।
কে বাতাসি ? জোয়ান লোকটা অত ভয়ংকরভাবে
তাকে ডাকে কেন ? কেন
হাওয়ার ভিতরে বাবরি-চুল উড়িয়ে
পাগলের মতো
“বাতাসি ! বাতাসি !” ব’লে ছুটে যায় ?
টুকরো টুকরো কথাগুলি ইদানিং যেন বড় বেশি—
গোঁয়ার মাছির মতো
জ্বালাচ্ছে । কে যেন কাকে বাসের ভিতরে
বলেছিল, “ভাবতে হবে না,
এবারে দুদ্দাড় করে হেমাঙ্গ ভীষণভাবে উঠে যাবে, দেখে নিস” ।
কে হেমাঙ্গ ? কে জানে, এখন
সত্যিই দুদ্দাড় ক’রে কোথাও উঠে যাচ্ছে কিনা ।
কিংবা সেই ছেলেটা, যে ট্রাম-স্টপে দাঁড়িয়ে পাশের
মেয়েটিকে অদ্ভুত কঠিন স্বরে বলেছিল,
“চুপ করো, না হলে আমি
সেই রকম শাস্তি দেব আবার—” কে জানে
“সেইরকম” মানে কি রকম । আমি ভেবে যাচ্ছি,
ক্রমাগত ভেবে যাচ্ছি, তবু—
গল্পের সবটা যেন নাগালে পাচ্ছি না ।
গল্পের সবটা আমি পাব না নাগালে ।
শুধু শুনে যাব । শুধু এখানে ওখানে,
জনারণ্যে, বাতাসের ভিতরে, হাটেমাঠে,
অথবা ফুটপাথে, কিংবা ট্রেনের জানলায়
টুকরো টুকরো কথা শুনবো, শুধু শুনে যাব । আর
হঠাত্ কখনো কোনো ভুতুড়ে দুপুরে
কানে বাজাবে “বাতাসি ! বাতাসি !”

>


দিঘির ভিতরে ছায়া ধীরে বড় হয়, ধীরে-ধীরে
নিজেকে গুটিয়ে আনে ফের ।
মাঝে মাঝে হাওয়া দেয় । জালের শরীরে
দোলা লাগে । ত্রিকালে দণ্ডায়মান বৃদ্ধ অশথের
শাখা-প্রশাখায়
ছড়ায় অস্ফুট কানাকানি ।
তীব্র নীল আকাশে নিঃসঙ্গ চিল উড়ে চলে যায় ।
জলের উপরে ভাসে অশথের শান্ত ছায়াখানি ।
আজও ছায়াখানি সেই জলের উপর শুয়ে আছে ।
মাঝে-মাঝে হাওয়া দেয়, মাঝে মাঝে ছায়া
কেঁপে ওঠে । কাছে
ঘরবাড়ি নেই, জনমনিষ্যির মমতা-মায়ার
চিহ্ন নেই । চতুর্দিকে মাঠ, শুধু মাঠ ।
মাঠের ভিতরে দিঘি, দিঘির ভিতরে ছায়া পড়ে ।
হাহা করে আকাশের জানালা-কপাট ।
মাঠ পাড়ি দিয়ে হাওয়া ছুটে যায় গ্রামে ও শহরে ।

>

সবাই দেখছে যে, রাজা উলঙ্গ, তবুও
সবাই হাততালি দিচ্ছে।
সবাই চেঁচিয়ে বলছে; শাবাশ, শাবাশ!
কারও মনে সংস্কার, কারও ভয়;
কেউ-বা নিজের বুদ্ধি অন্য মানুষের কাছে বন্ধক দিয়েছে;
কেউ-বা পরান্নভোজী, কেউ
কৃপাপ্রার্থী, উমেদার, প্রবঞ্চক;
কেউ ভাবছে, রাজবস্ত্র সত্যিই অতীব সূক্ষ্ম , চোখে
পড়ছে না যদিও, তবু আছে,
অন্তত থাকাটা কিছু অসম্ভব নয়।

গল্পটা সবাই জানে।
কিন্তু সেই গল্পের ভিতরে
শুধুই প্রশস্তিবাক্য-উচ্চারক কিছু
আপাদমস্তক ভিতু, ফন্দিবাজ অথবা নির্বোধ
স্তাবক ছিল না।
একটি শিশুও ছিল।
সত্যবাদী, সরল, সাহসী একটি শিশু।

নেমেছে গল্পের রাজা বাস্তবের প্রকাশ্য রাস্তায়।
আবার হাততালি উঠছে মুহুর্মুহু;
জমে উঠছে
স্তাবকবৃন্দের ভিড়।
কিন্তু সেই শিশুটিকে আমি
ভিড়ের ভিতরে আজ কোথাও দেখছি না।

শিশুটি কোথায় গেল? কেউ কি কোথাও তাকে কোনো
পাহাড়ের গোপন গুহায়
লুকিয়ে রেখেছে?
নাকি সে পাথর-ঘাস-মাটি নিয়ে খেলতে খেলতে
ঘুমিয়ে পড়েছে
কোনো দূর
নির্জন নদীর ধারে, কিংবা কোনো প্রান্তরের গাছের ছায়ায়?
যাও, তাকে যেমন করেই হোক
খুঁজে আনো।
সে এসে একবার এই উলঙ্গ রাজার সামনে
নির্ভয়ে দাঁড়াক।
সে এসে একবার এই হাততালির ঊর্ধ্বে গলা তুলে
জিজ্ঞাসা করুক:
রাজা, তোর কাপড় কোথায়?

>

অমলকান্তি আমার বন্ধু,
ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো, পড়া পারতো না,
শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে
এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে,
দেখে ভারি কষ্ট হত আমাদের।
আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।
ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম আর জামরুলের পাতায়
যা নাকি অল্প একটু হাসির মতন লেগে থাকে।
আমরা কেউ মাষ্টার হয়েছি। কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে।
মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে।
চা খায়, এটা-ওটা গল্প করে, তারপর বলে “উঠি তাহলে।”
আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।
আমাদের মধ্যে যে এখন মাষ্টারি করে,
অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারতো ;
যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল,
উকিল হলে তার এমন-কিছু ক্ষতি হত না।
অথচ, সকলেরই ইচ্ছে পূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারে নি।
সেই অমলকান্তি- রোদ্দুরের কথা ভাবতে ভাবতে
যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।