Archive for the ‘আহসান হাবীব (১৯১৭ – ১৯৮৫)’ Category

>

এই যে নদী
নদীর জোয়ার
নৌকা সারে সারে,
একলা বসে আপন মনে
বসে নদীর ধারে
এই ছবিটি চেনা।
মনের মধ্যে যখন খুশি
এই ছবিটি আঁকি
এক পাশে তার জারুল গাছে
দুটি হলুদ পাখি,
এমনি পাওয়া এই ছবিটি
কড়িতে নয় কেনা।

মাঠের পরে মাঠ চলেছে
নেই যেন এর শেষ
নানা কাজের মানুষগুলো
আছে নানান বেশ,
মাঠের মানুষ যায় মাঠে আর
হাটের মানুষ হাটে,
দেখে দেখে একটি ছেলের
সারাটাদিন কাটে।
এই ছেলেটির মুখ
সারাদেশের সব ছেলেদের
মুখেতে টুকটুক।
কে তুমি ভাই,
প্রশ্ন করি যখন,
ভালবাসার শিল্পী আমি,
বলবে হেসে তখন।

এই যে ছবি এমনি আঁকা
ছবির মত দেশ,
দেশের মাটি দেশের মানুষ
নানান রকম বেশ,
বাড়ি বাগান পাখ-পাখালি
সব মিলে এক ছবি,
নেই তুলি নেই রং তবুও
আঁকতে পারি সবই।

>…
আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।
মেঘনা নদীর ঢেউয়ের বুকে
তালের নৌকা বেয়ে
আমি বেড়াই হেসে খেলে
আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে।
মেঘনা নদীর নেয়ে আমি মেঘনা পাড়ে বাড়ি
ইচ্ছে হলেই এপার থেকে ওপারে দেই পাড়ি
তালে তালে তালের নৌকো
দু’হাতে যাই বেয়ে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।

পাহাড় সমান ঢেউয়ের বুকে নৌকা আমার ভাসে
মেঘমুলুকের পাহাড় থেকে ঝড়ের ঝাপটা আসে
মাথার ওপর মুচকি হাসে
বিজলী নামের মেয়ে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।

আমার ঢেউয়ের সঙ্গে গলাগলি ঢেউয়ের সঙ্গে খেলা
ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে কাটাই সারাবেলা
দেশ থেকে যাই দেশান্তরে
মনের নৌকো বেয়ে
আমি মেঘনা নদীর ছেলে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।
,,,

>…

    জেলের সেলে বন্দী ছিলো
মৃতের স্তুপের অন্ধকারে বন্দী ছিলো
বন্দী ছিলো বন্ধ দুয়ার
        ভয় থমথম ঘরের মাঝে।
শহর জুড়ে কারফ্যু তার কাফন ছড়ায়
        সেই কাফনে বন্দী ছিলো।

ওরা তখন মন্ত্রপুত মশাল নিয়ে নামলো পথে
মৃতের স্তুপে ফোটালো ফুল
নতুন প্রাণে গাঁথলো নতুন দীপাবলি।

আগুন জ্বলে। জ্বলতে থাকে পাশব আঁধার
গ্রাম নগরে রাত পেরিয়ে, রাত পেরিয়ে
                রাত পেরিয়ে
সূর্য নামে।

তখন দেখি
আলোর মুকুট মাথায় পরে
ভুবন জুড়ে বাইরে এলো বন্দিনী মা বাংলা আমার
                স্বদেশ আমার।

>…

জানো মা, পাখিরা বড় বোকা, ওরা কিছুই জানেনা।
যত বলি, কাছে এসো, শোনো শোনো, কিছুতেই মানেনা।

মিছেমিছি কেন ওরা ভয় পায়, ভয়ের কি আছে ?
বোঝেনা বোকারা, আমি ভালোবাসি তাই ডাকি কাছে।
দেখোনা, যখন কাল আমাদের আমবাগানের
পুবধারে ওরা সব বসিয়েছে আসর গানের-
আমি গিয়ে চুপ চুপে কিছু দূরে বসেছি যখন,
গান ভুলে বোকাগুলো একসাথে পালালো তখন।
ওরা কি জানেনা, আমি গান বড় ভালোবাসি, তাই
যখনি ওদের দেখি চুপে চুপে কাছে চলে যাই !

আচ্ছা মা, বলো দেখি কি করে কাটাব এই ভয়,
কি পেলে তখন ওরা সবচেয়ে বেশি খুশি হয় ?
সাদা কড়ি ওদের কি ভাল লাগে ? আমার যেমন
ছোট লাল ঘুড়ি আছে, মাজা সূতো, ওদের তেমন
আছে না কি ? কিছু নেই ? বেশ কথা, না-ই যদি থাকে
বোকারা নিজেরা এসে বলে যেতে পারে ত আমাকে,
আমি ত দিতেই চাই, বোকারা যে কখনো আসে না।
জানি, ওরা পাখি কি-না, মানুষকে ভালোই বাসে না।

বলোনা মা, কি করলে পাখিরাও খুব ভালোবাসে,
কি করলে পাখিরাও ভালোবেসে খুব কাছে আসে।

>…

তুমি ভালো না বাসলেই বুঝতে পারি ভালোবাসা আছে।
তুমি ভালো না বাসলেই ভালোবাসা জীবনের নাম
ভালোবাসা ভালোবাসা বলে
          দাঁড়ালে দু’হাত পেতে
                   ফিরিয়ে দিলেই
                   বুঝতে পারি ভালোবাসা আছে।

না না বলে ফেরালেই
বুঝতে পারি ফিরে যাওয়া যায় না কখনো।
না না বলে ফিরিয়ে দিলেই
ঘাতক পাখির ডাক শুনতে পাই চরাচরময়

সুসজ্জিত ঘরবাড়ি
সখের বাগান
সভামঞ্চে করতালি
জয়ধ্বনি পুষ্পার্ঘ্য ইত্যাদি
সব ফেলে
তোমার পায়ের কাছে অস্তিত্ব লুটিয়ে দিয়ে
তোমাকে না পেলে, জানি
যে পায়, সে পায়
কি অমূল্য ধন।

>

আসমানের তারা সাক্ষী
সাক্ষী এই জমিনের ফুল, এই
নিশিরাইত বাঁশবাগান বিস্তর জোনাকি সাক্ষী
সাক্ষী এই জারুল জামরুল, সাক্ষী
পূবের পুকুর, তার ঝাকড়া ডুমুরের পালে স্থিরদৃষ্টি
মাছরাঙা আমাকে চেনে
আমি কোনো অভ্যাগত নই
খোদার কসম আমি ভিনদেশী পথিক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই, আমি
ছিলাম এখানে, আমি স্বাপ্নিক নিয়মে
এখানেই থাকি আর
এখানে থাকার নাম সর্বত্রই থাকা –
সারা দেশে।

আমি কোনো আগন্তুক নই। এই
খর রৌদ্র জলজ বাতাস মেঘ ক্লান্ত বিকেলের
পাখিরা আমাকে চেনে
তারা জানে আমি কোনো অনাত্মীয় নই।
কার্তিকের ধানের মঞ্জরী সাক্ষী
সাক্ষী তার চিরোল পাতার
টলমল শিশির, সাক্ষী জ্যোৎস্নার চাদরে ঢাকা
নিশিন্দার ছায়া
অকাল বার্ধক্যে নত কদম আলী
তার ক্লান্ত চোখের আঁধার
আমি চিনি, আমি তার চিরচেনা স্বজন একজন। আমি
জমিলার মা’র
শূন্য খা খা রান্নাঘর শুকনো থালা সব চিনি
সে আমাকে চেনে

হাত রাখো বৈঠায় লাঙ্গলে, দেখো
আমার হাতের স্পর্শ লেগে আছে কেমন গভীর। দেখো
মাটিতে আমার গন্ধ, আমার শরীরে
লেগে আছে এই স্নিগ্ধ মাটির সুবাস।

আমাকে বিশ্বাস করো, আমি কোনো আগন্তুক নই।

দু’পাশে ধানের ক্ষেত
সরু পথ
সামনে ধু ধু নদীর কিনার
আমার অস্তিত্বে গাঁথা। আমি এই উধাও নদীর
মুগ্ধ এক অবোধ বালক।

>

: আপনারা যাচ্ছেন বুঝি ?
: চলে যাচ্ছি, মালপত্র উঠে গেছে সব ।
: বছর দুয়েক হল, তাই নয় ?
: তারো বেশী । আপনার ডাক নাম শানু, ভালো নাম ?
: শাহানা, আপনার ?
: মাবু ।
: জানি ।
: মাহবুব হোসেন । আপনি খুব ভালো সেলাই জানেন ।
: কে বলেছে । আপনার তো অনার্স ফাইন্যাল, তাই নয় ?
: এবার ফাইন্যাল ।
: ফিজিক্স-এ অনার্স ।
: কী আশ্চর্য ! আপনি কেন ছাড়লেন হঠাৎ ?
: মা চান না । মানে ছেলেদের সঙ্গে বসে…
: সে যাক গে, পা সেরেছে ?
: কী করে জানলেন ?
: এই আর কি ! সেরে গেছে ?
: ও কিছুনা , প‌্যাসেজটা পিছলে ছিল মানে…
: সত্যি নয় । উচুঁ থেকে পড়ে গিয়ে…
: ধ্যাৎ । খাবার টেবিলে রোজ মাকে অতো জ্বালানো কি ভালো ?
: মা বলেছে ?
: শুনতে পাই । বছর দুয়েক হল, তাই নয় ?
: তারো বেশী । আপনার টবের গাছে ফুল এসেছে ?
: নেবেন ? না থাক । রিকসা এল, মা এলেন , যাই ।
: আপনি সন্ধ্যে বেলা ওভাবে কখনও পড়বেন না,
চোখ যাবে, যাই ।
: হলুদ শার্টের মাঝখানে বোতাম নেই, লাগিয়ে নেবেন, যাই ।
: যান, আপনার মা আসছেন । মা ডাকছেন, যাই ।