Archive for the ‘সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৯২৬ – ১৯৪৭)’ Category

বন্ধু, তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত,
বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।
মূঢ় শত্রুকে হানো স্রোত রুখে, তন্দ্রাকে করো ছিন্ন,
একাগ্র দেশে শত্রুরা এসে হয়ে যাক নিশ্চিহ্ন।
ঘরে তোল ধান, বিপ্লবী প্রাণ প্রস্তুত রাখ কাস্তে,
গাও সারিগান, হাতিয়ারে শান দাও আজ উদয়াস্তে।
আজ দৃঢ় দাঁতে পুঞ্জিত হাতে প্রতিরোধ করো শক্ত,
প্রতি ঘাসে ঘাসে বিদ্যুৎ আসে জাগে সাড়া অব্যক্ত। (বিস্তারিত…)

>…
রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে
রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে,
রানার চলেছে, রানার !
রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার।
দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার-
কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার।

রানার ! রানার !
জানা-অজানার
বোঝা আজ তার কাঁধে,
বোঝাই জাহাজ চলেছে চিঠি আর সংবাদে;
রানার চলেছে, বুঝি ভোর হয় হয়,
আরো জোরে, আরো জোরে, এ রানার দূর্বার দূর্জয়।
তার জীবনের স্বপ্নের মত পিছে সরে যায় বন,
আরো পথ, আরো পথ-বুঝি হয় লাল ও পূর্ব কোণ।
অবাক রাতের তারারা আকাশে মিটমিট করে চায়;
কেমন ক’রে এ রানার সবেগে হরিণের ম ধায় !
কত গ্রাম, কত পথ যায় স’রে স’রে
শহরে রানার যাবেই পৌঁছে ভোরে;
হাতে লণ্ঠন করে ঠনঠন্ জোনাকিরা দেয় আলো
মাভৈঃ রানার ! এখনো রাতের কালো।

এমনি ক’রেই জীবনের বহু বছরকে পিছু ফেলে,
পৃথিবীর বোঝা ক্ষুধিত রানার পৌঁছে দিয়েছে ‘মেলে’।
ক্লান্তশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামে
জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে।
অনেক দুঃখ, বহু বেদনায়, অভিমানে অনুরাগে
ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে।
রানার ! রানার !
এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে ?
রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে ?
ঘরেতে অভাব; পৃথিবীটা তাই মনে হয় কালো ধোঁয়া,
পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া,
রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে,
দস্যুর ভয়, তারো চেয়ে ভয় কখন সূর্য ওঠে
কত চিঠি লেখে লোকে-
কত সুখে, প্রেমে, আবেগে, স্মৃতিতে, কত দুঃখে ও শোকে
এর দুঃখের চিঠি পড়বে না জানি কেউ কোনো দিনও,
এর জীবনের দুঃখ কেমন, জানবে পথের তৃণ
এর দুঃখের কথা জানবে না কেউ শহরে ও গ্রামে,
এর কথা ঢাকা পড়ে থাকবেই পাঠাবে সহানুভূতির খামে-
রানার ! রানার ! কী হবে এ বোঝা ব’য়ে।
কী হবে ক্ষুধার ক্লান্তিকে ক্ষ’য়ে ক্ষ’য়ে ?
রানার ! রানার ! ভোর তো হয়েছে- আকাশ হয়েছে লাল,
আলোর স্পর্শে কবে কেটে যাবে এই দুঃখের কাল ?
রানার ! গ্রামের রানার !
সময় হয়েছে নতুন খবর আনার;
শপথের চিঠি নিয়ে চল আজ
              ভীরুতা পিছনে ফেলে-
পৌঁছে দাও এ নতুন খবর
              অগ্রগতির ‘মেলে’,
দেখা দেবে বুঝি প্রভাত এখুনি-
নেই, দেরী নেই আর,
ছুটে চলো, ছুটে চলো, আরো বেগে
দুর্দম, হে রানার।।

>…

আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি
এত নগণ্য, হয়তো চোখেও পড়ি না;
তবু জেনো
মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ—
বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস;
আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠি।

মনে আছে সেদিন হুলুস্থুল বেধেছিল?
ঘরের কোণে জ্বলে উঠেছিল আগুন –
আমাকে অবজ্ঞাভরে না-নিভিয়ে ছুঁড়ে ফেলায়!
কত ঘরকে দিয়েছি পুড়িয়ে,
কত প্রাসাদকে করেছি ধূলিসাত্‍‌
আমি একাই- ছোট্ট একটা দেশলাইয়ের কাঠি।

এমনি বহু নগর, বহু রাজ্যকে দিতে পারি ছারখার করে
তবুও অবজ্ঞা করবে আমাদের?
মনে নেই? এই সেদিন-
আমরা সবাই জ্বলে উঠেছিলাম একই বাক্সে;
চমকে উঠেছিলে–আমরা শুনেছিলাম তোমাদের বিবর্ণ মুখের আর্তনাদ।

আমাদের কী অসীম শক্তি
তা তো অনুভব করেছো বারংবার;
তবু কেন বোঝো না,
আমরা বন্দী থাকবো না তোমাদের পকেটে পকেটে,
আমরা বেরিয়ে পড়ব, আমরা ছড়িয়ে পড়ব
শহরে, গঞ্জে, গ্রামে– দিগন্ত থেকে দিগন্তে।
আমরা বার বার জ্বলি, নিতান্ত অবহেলায়-
তা তো তোমরা জানোই!
কিন্তু তোমরা তো জানো না:
কবে আমরা জ্বলে উঠব-
সবাই– শেষবারের মতো!

>

ভেজাল, ভেজাল ভেজাল রে ভাই, ভেজাল সারা দেশটায়,
ভেজাল ছাড়া খাঁটি জিনিষ মিলবে নাকো চেষ্টায়!
ভেজাল তেল আর ভেজাল চাল, ভেজাল ঘি আর ময়দা,
`কৌন ছোড়ে গা ভেজাল ভেইয়া, ভেজালসে হ্যায় ফয়দা।’
ভেজাল পোশাক ভেজাল খাবার, ভেজাল লোকের ভাবনা,
ভেজালেরই রাজত্ব এ পাটনা থেকে পাবনা।
ভেজাল কথা— বাংলাতে ইংরেজী ভেজাল চলছে,
ভেজাল দেওয়া সত্যি কথা লোকেরা আজ বলছে।
`খাঁটি জিনিষ’ এই কথাটা রেখো না আর চিত্তে,
`ভেজাল’ নামটা খাঁটি কেবল আর সকলই মিথ্যে।
কলিতে ভাই `ভেজাল’ সত্য ভেজাল ছাড়া গতি নেই,
ছড়াটাতেও ভেজাল দিলাম, ভেজাল দিলে ক্ষতি নেই॥

>


আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
র্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।

আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়–
আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা।

এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য
বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে,
প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঝুলিটা থাকে না শূন্য
সঁপে আত্মাকে শপথের কোলাহলে।

আঠরো বছর বয়স ভয়ঙ্কর
তাজা তাজা প্রাণে অসহ্য যন্ত্রণা,
এ বয়সে প্রাণ তীব্র আর প্রখর
এ বয়সে কানে আসে কত মন্ত্রণা।

আঠারো বছর বয়স যে দুর্বার
পথে প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান,
দুর্যোগে হাল ঠিক মতো রাখা ভার
ক্ষত-বিক্ষত হয় সহস্র প্রাণ।

আঠারো বছর বয়সে আঘাত আসে
অবিশ্র্রান্ত; একে একে হয় জড়ো,
এ বয়স কালো লক্ষ দীর্ঘশ্বাসে
এ বয়স কাঁপে বেদনায় থরোথরো।

তব আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি,
এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে,
বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী
এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে।

এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়
পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,
এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়–
এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।

>…

হে মহামানব,আর এ কাব্য নয়
এবার কঠিন কঠোর গদ্য আনো,
পদ-লালিত্য-ঝস্কার মুছে যাক
গদ্যের কড়া ঘাতুড়িকে আজ হানো।
প্রয়োজন নেই কবিতার স্নিগ্ধতা-
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝল্‌সানো রুটি।

>

যে শিশু ভুমিষ্ঠ হলো আজ রাত্রে
তার মুখে খবর পেলুম :
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার
জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে ।

খর্বদেহ নিঃসহায় তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত
উত্তোলিত, উদ্ভাসিত
কী এক দুর্ব্যোধ্য প্রতিজ্ঞায় ।

সে ভাষা বুঝে না কেউ,
কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার ।

আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা
পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের–
পরিচয় পত্র পড়ি ভুমিষ্ঠ শিশুর,
অষ্পষ্ট কুয়াশা ভরা চোখে ।

এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান,
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের ।

চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপনে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি–
নব জাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার ।

অবশেষে সব কাজ সেরে
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হবো ইতিহাস ।

>…
একটি মোরগ হঠাৎ আশ্রয় পেয়ে গেল
বিরাট প্রাসাদের ছোট্ট এক কোণে,
ভাঙা প্যাকিং বাক্সের গাদায়-
আরো দু’তিনটি মুরগির সঙ্গে
আশ্রয় যদিও মিলল,
উপযুক্ত আহার মিলল না।
সুতীব্র চীৎকারে প্রতিবাদ জানিয়ে
গলা ফাটাল সেই মোরগ
ভোর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত-
তবুও সহানুভূতি জানাল না সেই বিরাট শক্ত ইমারত।

তারপর শুরু হল তার আস্তাকুঁড়ে আনাগোনা:
আশ্চর্য! সেখানে প্রতিদিন মিলতে লাগল
ফেলে দেওয়া ভাত-রুটির চমৎকার প্রচুর খাবার!

তারপর এক সময় আস্তাকুঁড়েও এল অংশীদার-
ময়লা ছেঁড়া ন্যাকড়া পরা দু’তিনটে মানুষ;
কাজেই দুর্বলতর মোরগের খাবার গেল বন্ধ হয়ে।

খাবার! খাবার! খানিকটা খাবার!
অসহায় মোরগ খাবারের সন্ধানে
বার বার চেষ্টা ক’রল প্রাসাদে ঢুকতে,
প্রত্যেকবারই তাড়া খেল প্রচণ্ড।
ছোট্ট মোরগ ঘাড় উঁচু করে স্বপ্ন দেখে-
‘প্রাসাদের ভেতর রাশি রাশি খাবার’!

তারপর সত্যিই সে একদিন প্রাসাদে ঢুকতে পেল,
একেবারে সোজা চলে এল
ধবধবে সাদা দামী কাপড়ে ঢাকা খাবার টেবিলে;
অবশ্য খাবার খেতে নয়-
খাবার হিসেবে।