Archive for the ‘তারাপদ রায় (১৯৩৬ – )’ Category

>…
আমি মমতা থেকে তুলে এনেছিলাম পরিহাস
আমি বিষাদ থেকে তুলে এনেছিলাম অশ্রু
আমি ঘুম থেকে তুলে এনেছিলাম স্বপ্ন
আমি স্মৃতি থেকে তুলে এনেছিলাম অভিমান
আমি শব্দ থেকে তুলে এনেছিলাম কবিতা
            তুমি কোনোদিন কিছুই খেয়াল করোনি

আমি বিষাদসিন্ধুর তীরে দাঁড়িয়ে ডুগডুগি বাজিয়েছিলাম
তুমি সেই বাঁদরনাচের বাজনা শুনতে পাওনি।
উত্তরের অনন্ত বাতাসে ঝরা পাতার মতো উড়ে উড়ে পড়েছে

আমার পরিহাসময় অশ্রু, আমার স্বপ্নময় অভিমান।

তুমি লাল মখমলের চটি পায়ে রেশমের চাদর জড়িয়ে
উজ্জ্বল রোদের মধ্যে উদাসীন হেঁটে গেছো
তোমার পায়ের প্রান্তে ঘুরে ঘুরে লুটিয়ে পড়েছে
ঝরা পাতার মতো আমার পরিহাস, আমার কবিতা
তোমার শ্রুতি ছুঁয়ে ভেসে গেছে আমার ডুগডুগির বোল

বছরের পর বছর, দিনের পর দিন
গ্রীষ্ম নেই, বর্ষা নেই, শুধু শীত আর শীতের হাওয়া
ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন, স্বপ্নের মধ্যে অভিমান
শীতল অভিমানে জড়ানো ঠাণ্ডা হাওয়ায় ঝরা পাতা
এলোমেলো ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে রোদের উজ্জ্বলতায়।
             তুমি উদাসীন চলে গেছো
             কোনোদিন তাকিয়ে দেখোনি,
             তুমি কোনোদিন শুনলে না
             আমার ডুগডুগি, আমার বাঁদরনাচের বাজনা।

>…

আমি নিতান্ত গরিব ছিলাম, খুবই গরিব।
আমার ক্ষুধার অন্ন ছিল না,
আমার লজ্জা নিবারণের কাপড় ছিল না,
আমার মাথার উপরে আচ্ছাদন ছিল না।
অসীম দয়ার শরীর আপনার
আপনি এসে আমাকে বললেন,
‘না, গরিব কথাটা খুব খারাপ,
ওতে মানুষের মর্যাদাহানি হয়,
তুমি আসলে দরিদ্র।’

অপরিসীম দারিদ্র্যের মধ্যে আমার কষ্টের দিন,
আমার কষ্টের দিন, দিনের পর দিন আর শেষ হয় না,
আমি আরো জীর্ণ আরো ক্লিষ্ট হয়ে গেলাম,
হঠাৎ আপনি আবার এলেন, এসে বললেন,
‘দ্যাখো, বিবেচনা করে দেখলাম
দরিদ্র শব্দটাও ভালো নয়, তুমি হলে নিঃস্ব।’

দীর্ঘ নিঃস্বতায় আমার দিনরাত্রি
গনগনে গরমে ধুঁকতে ধুঁকতে,
শীতের রাতের ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে
বর্ষার জলে ভিজতে ভিজতে
আমি নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে গেলাম।
আপনার কিন্তু ক্লান্তি নেই,
আপনি আবার এলেন, আপনি বললেন,
‘তোমার নিঃস্বতার কোনো মানে হয় না।
তুমি নিঃস্ব হবে কেন,
তোমাকে চিরকাল শুধু বঞ্চনা করা হয়েছে,
তুমি বঞ্চিত, তুমি চির বঞ্চিত।’
আমার বঞ্চনার অবসান নেই,
বছরের পর বছর আধপেটা খেয়ে,
উদোম আকাশের নিচে রাস্তায় শুয়ে,
কঙ্কালসার হয়ে আমার বেঁচে থাকা।

কিন্তু আপনি আমাকে ভোলেননি,
এবার আপনার মুষ্টিবদ্ধ হাত,
আপনি এসে উদাত্ত কণ্ঠে ডাক দিলেন,
‘জাগো, জাগো সর্বহারা।’
তখন আর আমার জাগবার ক্ষমতা নেই,
ক্ষুধায় অনাহারে আমি শেষ হয়ে এসেছি,
আমার বুকের পাঁজর হাপরের মতো ওঠানামা করছে,
আপনার উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে
আমি তাল মেলাতে পারছি না।

ইতিমধ্যে আরো বহুদিন গিয়েছে,
আপনি এখন আরো বুদ্ধিমান,
আরো চৌকস হয়েছেন।
এবার আপনি একটি ব্ল্যাক-বোর্ড নিয়ে এসেছেন,
সেখানে চকখড়ি দিয়ে যত্ন করে
একটা ঝকঝকে লম্বা লাইন টেনে দিয়েছেন;
এবার বড়ো পরিশ্রম হয়েছে আপনার,
কপালের ঘাম মুছে আমাকে বলেছেন,
‘এই যে রেখা দেখছ, এর নিচে,
অনেক নিচে তুমি রয়েছ।’

চমৎকার !
আপনাকে ধন্যবাদ, বহু ধন্যবাদ !
আমার গরিবপনার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আমার দারিদ্র্যের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ,
আমার নিঃস্বতার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ,
আমার বঞ্চনার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আমার সর্বহারাত্বের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ,
আর সবশেষে ঐ ঝকঝকে লম্বা রেখাটি,
ঐ উজ্জ্বল উপহারটির জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।
কিন্তু, ক্রমশ, আমার ক্ষুধার অন্ন এখন আরো কমে গেছে.
আমার লজ্জা নিবারণের কাপড় এখন আরো ছিঁড়ে গেছে,
আমার মাথার উপরের আচ্ছদন আরো সরে গেছে।
কিন্তু ধন্যবাদ,
হে প্রগাঢ় হিতৈষী, আপনাকে বহু ধন্যবাদ।

>

অনেকদিন দেখা হবে না
তারপর একদিন দেখা হবে।
দু’জনেই দু’জনকে বলবো,
‘অনেকদিন দেখা হয়নি’।
এইভাবে যাবে দিনের পর দিন
বৎসরের পর বৎসর।
তারপর একদিন হয়ত জানা যাবে
বা হয়ত জানা যাবে না,
যে
তোমার সঙ্গে আমার
অথবা
আমার সঙ্গে তোমার
আর দেখা হবে না।

>

আমরা যারা দিন আনি, দিন খাই,
আমরা যারা হাজার হাজার দিন খেয়ে ফেলেছি,
বৃষ্টির দিন, মেঘলা দিন, কুয়াশা ঘেরা দিন,
স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে অধীর প্রতীক্ষারত দিন,
অপমানে মাথা নিচু করে চোরের মতো চলে যাওয়া দিন,
খালি পেট, ছেঁড়া চটি, ঘামে ভেজা দিন,
নীল পাহাড়ের ওপারে, সবুজ বনের মাথায় দিন,
নৌকার সাদা জালে ঢেউয়ের চুড়ায় ভেসে যাওয়ার দিন,
হৈ হৈ অট্টহাসিতে কলরোল কোলাহল ভরা দিন,
হঠাৎ দক্ষিণের খোলা বারান্দায় আলো ঝলমলে দিন-
এই সব দিন আমরা কেমন করে এনেছিলাম, কিভাবে,
কেউ যদি হঠাৎ জানতে চায়, এ রকম একটা প্রশ্ন করে,

আমরা যারা কিছুতেই সদুত্তর দিতে পারবো না,
কিছুই বলতে পারবো না, কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারবো না
কি করে আমরা দিন এনেছিলাম,
কেন আমরা দিন আনি, কেন আমরা দিন খাই,
কেমন করে আমরা দিন আনি, দিন খাই।