Archive for the ‘আবুল হাসান (১৯৪৭ – ১৯৭৫)’ Category

>…
প্রতিটি নতুন কথা বলাটাই হলো আমাদের প্রেম,
প্রতিটি নতুন শব্দই হলো শিল্পকলার সীমাঃ
              হে অসীমা তুমি কথা বলছো না কেন ?
ওষ্ঠে কাঁপন ধরানোই হলো
              নিবিড় নিহিত আবেগের চুম্বন।
এসো তবে ঠোঁটে কাঁপন ধরাই
দু’জনের ঠোঁটে দূরের কুজন, হাওয়া শনশন্ চুম্বন গড়ে তুলি।
একাকী থেকেও এখন আমরা এসো দু’জনের মুগ্ধতা আনি মুখে
কপালে কাঁপাই ভ্রূযুগল অনুভূতি।
বাতাসে বহাই চক্ষুর সম্মতি।
এসো সতী মেয়ে আবার আমরা শুয়ে পড়ি, সেতু বাঁধি
              দুই শরীরের মিলনে ঐকতান,
সংরাগে দেই সুন্দর করতালিঃ
আমাদের দুটি হৃদয়ে আজকে প্রথম ধরেছে কলি,
এসো উদ্যানে পুষ্প পবনে অঙ্গার হয়ে জ্বলি।
সূর্যে তারায় শত শনশন সবুজ ডেরায় আমি তুলি ঝঙ্কার
              কান পেতে তুমি তাই শোনো মৃত্তিকা,
এসো সুন্দর, এসো হে শহরতলী,
আমাকে বানাও ঘন সবুজের শিখা,
              তুমি তো বনস্থলী,
তোমাকে কে চেনে আর
আমি ছাড়া আর কে জানে তোমার কেন এ অহঙ্কার,
কেন নিশ্চুপ, কথা বলছো না হৃদয়ে পূর্ণিমার
জ্যোৎস্নায় তুমি কথা বলছো না কেন।

>…
সব রৌদ্র ফিরে যায় না, লুকিয়ে থাকে
            রাতের ফাঁকে যেমন তুমি।
কোথায় ছিলে ? কোন্ পাহাড় কোন্ পোস্টাফিসে
            চিঠির মতো
ভোরের মতো কোন্ জানালায় তাকিয়ে ছিলে
            চোখের ছায়ায় ?
সব রৌদ্র ফিরে যায় না লুকিয়ে থাকে
            পথের পাশে
কাঁচের মতন গোল গেলাসে
            জলের ছায়ায়
ফিরে আসে, যেমন তুমি ফিরে এলে।

>…
তোমার বাঁশির ফুঁয়ে পরান্মুখ: গন্ধহীন পরস্পরে যাই
পিছনে আমার পড়ে থাক নিবাস অতল বৃক্ষ মহামতী
সারি সারি বিনাশী বান্ধব, যাই মাছের সবুজ নীড় ছেড়ে
যতদূর পারি, নীল স্নায়ুর ভেতর শো’ শো’ তরল জাহাজে চ’ড়ে
হে শরীর, সৃজন অনাদি।

এবার বিদায় তবে বিপরীতে, অভিভূত চাষা, শুধু আমার সত্তা, স্বপ্ন
গন্ধের বিভায় থাক নারী পুরুষের মতো অরণ্যে শুয়ে এই উপদ্রবহীনে,
              অক্ষত !
বিদায় নেবোই, তবু সাঁঝবেলা, হে উর্বর শরীর মাংসাশী
জীর্ণানী আমাকে আর কতোকাল মৎসে ভুলাবে ?

>…

একসময় ইচ্ছে জাগে, মেষপালকের বেশে ঘুরিফিরি;
অরণ্যের অন্ধকার আদিম সর্দার সেজে মহুয়ার মাটির বোতল
ভেঙ্গে উপজাতি রমণীর বল্কল বসন খুলে জ্যোৎস্নায় হাঁটু গেড়ে বসি-

আর তারস্বরে বলে উঠি নারী, আমি মহুয়া বনের এই
সুন্দর সন্ধ্যায় পাপী, তোমার নিকটে নত, আজ কোথাও লুকানো কোনো
কোমলতা নেই, তাই তোমার চোখের নীচে তোমার ভ্রুর নীচে
                                           তোমার তৃষ্ণার নীচে
এই ভাবে লুকিয়েছি পিপাসায় আকণ্ঠ উন্মাদ আমি
ক্ষোভে ও ঈর্ষায় সেই নগরীর গুপ্তঘাতক আজ পলাতক, খুনী
আমি প্রেমিককে পরাজিত করে হীন দস্যুর মতোন
খুনীকে খুনীর পাশে রেখে এখানে এসেছি, তুমি
আমাকে বলো না আর ফিরে যেতে, যেখানে কেবলি পাপ, পরাজয়
পণ্যের চাহিদা, লোভ, তিরীক্ষু-মানুষ- যারা কোজাগরী ছুরি
বৃষ্টির হল্লায় ধুয়ে প্রতি শনিবারে যায় মদ্যশালায়, যারা
তমসায় একফোঁটা আলোও এখন আর উত্তোলন করতে জানে না।
আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়ে কেবলি যাদের রক্ত, রাত্রিবেলা আমি আজ
তোমার তৃষ্ণার নীচে নিভৃতের জ্যোৎস্নায় হাঁটু গেড়ে বসেছি আদিম আজ
এখন আমার কোন পাপ নেই, পরাজয় নেই।
একসময় ইচ্ছে জাগে, এভাবেই অরণ্যে অরণ্যে ঘুরে যদি দিন যেতো।

>…

চলে গেলে- তবু কিছু থাকবে আমার : আমি রেখে যাবো
আমার একলা ছায়া, হারানো চিবুক, চোখ, আমার নিয়তি।
জল নেমে গেলে ডাঙ্গা ধরে রাখে খড়কুটো, শালুকের ফুল :
নদীর প্রবাহপলি, হয়তো জন্মের বীজ, অলঙ্কার- অনড় শামুক !

তুমি নেমে গেলে এই বক্ষতলে সমস্ত কি সত্যিই ফুরোবে ?
মুখের ভিতরে এই মলিন দাঁতের পংক্তি- তা হলে এ চোখ
মাথার খুলির নীচে নরোম নির্জন এক অবিনাশী ফুল :
আমার আঙ্গুলগুলি, আমার আকাঙ্ক্ষাগুলি, অভিলাষগুলি ?

জানি কিছু চিরকাল ভাস্বর উজ্জ্বল থাকে, চির অমলিন !
তুমি চলে গেলে তবু থাকবে আমার তুমি, চিরায়ত তুমি !

অনুপস্থিতি হবে আমার একলা ঘর, আমার বসতি !

ফিরে যাবো সংগোপনে, জানবে না, চিনবে না কেউ;
উঠানে জন্মাবো কিছু হাহাকার, অনিদ্রার গান-

আর লোকে দেখে ভাববে- বিরহবাগান ঐ উঠানে তো বেশ মানিয়েছে !

>…

পুনর্বার স্রোতে ভাসছে হাঁস, ভাসতে দাও
                  কোমল জলের ঘ্রাণ মাখুক হাঁসেরা;
বহুদিন পর ওরা জলে নামছে, বহুদিন পর ওরা কাটছে সাঁতার
                  স্রোতে রাজহাঁস আসছে, আসতে দাও,

বহুদিন পর যেনো রোদ আসছে, আসতে দাও
                 নত হতে দাও আকাশকে,
                 আর একটু নত হোক আলো
                 আর একটু নির্জন হোক অন্ধকার !

আর তুমি পরে নাও তোমার গহনা, দুল
তোমার আঙ্গুল হোক হেমন্তের ফুল,
                  আমি শুঁকি, শুঁকতে দাও !

বহুদিন পর যেনো শুঁকছি বকুল !
বহুদিন তোমার ভিতরে যাইনা, বহুদিন বকুল ফুলের ঘ্রাণ
                  পাইনা এ মনে !

মনে করতে দাও তবু কোনখানে বকুলবাগান ছিল
                   গেরস্থের হাজার দুয়ারী ঘরবাড়ি
                   উঁচু আসন, সিংহাসন
মনে করো, মনে কোরে নাও
আমাদেরও সিংহাসন আছে আজও
আমাদের হাজার দুয়ারী বাড়ি আছে

মাটির ময়ূর, ঠোঁটে ঠোঁট, ফুলে ফুল
লুকোনো ডাকবাকস আছে সবুজের কাছে
মনে করো আমাদেরও ভালোবাসা আছে
খাগের কলমে লেখা তাদের অক্ষরগুলি
ধানের শীষের মতো টলমলায় সেখানে শরীরে

তুমি মনে করো, মনে করে নাও
তোমার শরীরে শাড়ি,
গেরস্থের হাজার দুয়ারী ঘরবাড়ি
আলো আর অন্ধকার মনে করো, মনে করে নাও
আমরা নৌকার জলে ভাসতে ভাসতে যেনো প্রতীকের হাঁস
                   ঐ রাজহাঁস
জল থেকে আরো জলে,
ঢেউ থেকে আরো ঢেউয়ে ছড়াতে ছড়াতে
                   পৌঁছে যাবো আগে।

>…

তোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ পড়ে আছে দ্যাখো প্রশান্ত টেবিলে
আর আমার হাত ঘড়ি
নীল ডায়ালের তারা জ্বলছে মৃদু আমারই কব্জিতে !

টুরিস্টের মতো লাগছে দেখতে আমাকে
সাংবাদিকের মতো ভীষণ উৎসাহী

এ মুহূর্তে সিগ্রেটের ছাই থেকে
শিশিরের মতো নম্র অপেক্ষার কষ্টগুলি ঝেড়ে ফেলেছি কালো এ্যাসট্রেতে !

রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসবেনা আজ স্বাতী ?

তোমার কথার মতো নরম সবুজ
কেকগুলি পড়ে আছে একটি পিরিচে

তোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ !

তোমার হাসির মতো উড়ছে চাইনিজ পর্দা রেস্তোরাঁয়

আর একটি অস্থির নীল প্রজাপতি পর্দার বুনট থেকে উড়ে এসে
                   ঢুকে গেছে আমার মাথায় !

রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসছোনা আজ স্বাতী ?

রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসবেনা আর স্বাতী ?

>…
(নির্মলেন্দু গুণকে)

দালান উঠছে তাও রাজনীতি, দালান ভাঙছে তাও রাজনীতি,

দেবদারু কেটে নিচ্ছে নরোম কুঠার তাও রাজনীতি,

গোলাপ ফুটছে তাও রাজনীতি, গোলাপ ঝরছে তাও রাজনীতি !

মানুষ জন্মাচ্ছে তাও রাজনীতি, মানুষ মরছে তাও রাজনীতি !

বোন তার বেণী খুলছে, যৌবনের অসহায় রোদে মুখ নত কোরে
বুকের ভ্রমর হাতে রাখছে লুকিয়ে- তাও রাজনীতি

তরুণেরা অধঃপাতে যাচ্ছে তাও রাজনীতি পুনরায়
মারামারি যুদ্ধ আর অত্যাচার, হত্যার আগ্রাসী খুন মানুষের
ছাড়ানো বীর্যের ব্যথা, বিষণ্ন মিথুন
মহিলার রক্তের ভিতরে ভ্রুণ, সমস্যার ছদ্মবেশে আবার আগুন
                            উর্বর হচ্ছে, রাজনীতি, তাও রাজনীতি !

আমি পকেটে দুর্ভিক্ষ নিয়ে একা একা অভাবের রক্তের রাস্তায় ঘুরছি
জীবনের অস্তিত্বে ক্ষুধায় মরছি রাজনীতি, তাও রাজনীতি আর

বেদনার বিষবাষ্পে জর্জরিত এখন সবার চতুর্দিকে খাঁ, খাঁ, খল,
তীব্র এক বেদেনীর সাপ খেলা দেখছি আমি; রাজনীতি তাও কি
                                           রাজনীতি ?

>…
(সুফিয়া চৌধুরীকে)

সেই সুখ মাছের ভিতরে ছিল,
সেই সুখ মাংসের ভিতরে ছিল,
রাতের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যেতো ছেলেবেলা
সেই সুখ চাঁদের ভিতরে ছিল,
সেই সুখ নারীর ভিতরে ছিল !

নারী কোন রমণীকে বলে ?
যার চোখ মুখ স্তন ফুটেছে সেই রমণী কি নারী ?
সেই সুখ নারীর ভিতরে ছিল,
যখন আমরা খুব গলাগলি শুয়ে
অনু অপলাদের স্তন শরীর মুখ উরু থেকে
অকস্মাৎ ঝিনুকের মতো যোনি,
অর্থাৎ নারীকে আমরা যখোন খুঁজেছি
হরিণের মতো হুররে দাঁত দিয়ে ছিঁড়েছি তাদের নখ, অন্ধকারে
সেই সুখ নারীর ভিতরে ছিল।

যখন আমরা শীতে গলাবন্ধে পশমী চাদর জড়িয়েছি
কিশোরীর কামরাঙা কেড়ে নিয়ে দাঁত বসিয়েছি
সেই সুখ পশমী চাদরে ছিল, কামরাঙা কিশোরীতে ছিল !

রঙীন বুদ্বুদ মাছ, তাজা মাংস, সুপেয় মশলার ঘ্রাণ;
চিংড়ি মাছের ঝোল যখোন খেতাম শীতল পাটিতে বসে
সেই সুখ শীতল পাটিতে ছিল।

প্রথম যে কার ঠোঁটে চুমু খাই মনে নেই
প্রথম কোনদিন আমি স্নান করি মনে নেই
কবে কাঁচা আম নুন লঙ্কা দিয়ে খেতে খেতে
                         দাঁত টক হয়েছিল মনে নেই
মনে নেই কবে যৌবনের প্রথম মিথুন আমি ঘটিয়েছিলাম
                                 মনে নেই…
যা কিছু আমার মনে নেই তাই হলো সুখ !
                          আহ ! সে সুখ…

>…

(হেলাল, কাঞ্চন, ওয়ালী, বাচ্চু ও রাব্বীকে)

যে বন্ধুরা কৈশোরে নারকেল বনের পাশে বসে
আত্মহত্যার মতো বিষণ্ন উপায়ে উষ্ণ মেয়েদের গল্প কোরতো
শীতকালে চাঁদের মতোন গোল বোতামের কোট পড়ে
                       ঘুরতো পাড়ায়,
যে বন্ধুরা থিয়েটারে পার্ট কোরতো,
কেউ সাজতো মীরজাফর, কেউবা সিরাজ
                        তারা আজ, এখন কোথায় ?

রোমেনা যে পড়াতো ইশকুলে ছোট মনিদের বিদ্যালয়ে
রোমেনা যে বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাস পড়ে তার
                         নায়িকার মতো জ্বরে ভুগতো,
আর মিহি শরীরের সাথে মিল রেখে
                         কপালে পরতো টিপ,
শাদা কোমরের কাছে দীর্ঘচুল ঝুলিয়ে রাখতো
                          ব্লু কালারের ব্যাগ,

দু’বৎসর আগে শুনেছি বিবাহ হ’য়ে গেছে তার,
                          এখন কোথায় ?

রুনী তার মাতাল স্বামীর কাছে না গিয়ে নিজেই একরাতে
একে একে শূন্যতায় সলজ্জ কাপড়গুলি খুলে ফেলে কুয়াশায়
উন্মাদিনী কোথায় পালালো !
নিজস্ব ভ্রুণের হত্যা গেঁথে দিয়েছিল তাকে মানসিক হাসপাতালের এক কোণে !
কোথায় সে ? এখন কোথায় ?

অনেকেই চলে গেছে, অনেক নারকেল গাছ হয়ে গেছে বুড়ো
অনেক প্রাঙ্গণ থেকে উঠে গেছে
গোলাপ চারার মতো সুন্দর বয়সমাখা প্রসিদ্ধা তরুণী,

মধ্যরাতে নারকেল বনের কাছে ভেঙে যায় আমারও গল্পগুলি
স্মৃতিকথা সেখানে নিশ্চুপ !