Archive for the ‘কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯ – ১৯৭৬)’ Category

>…
সাহেব কহেন,  “চমৎকার ! সে চমৎকার !”
মোসাহেব বলে,  “চমৎকার সে হতেই হবে যে !
                     হুজুরের মতে অমত কার ?”
সাহেব কহেন,  “কী চমৎকার,
                   বলতেই দাও, আহা হা।”
মোসাহেব বলে, “হুজুরের কথা
                    শুনেই বুঝেছি, বাহাহা বাহাহা বাহাহা !”
সাহেব কহেন,   “কথাটা কি জান ? সেদিন– ?
                    মোসাহেব বলে, “জানি না আবার ?
                    ঐ যে, কি বলে, যেদিন–“
সাহেব কহেন,   “যেদিন বিকেলে বৃষ্টিটা ছিল স্বল্প।”
মোসাহেব বলে, “আহা হা, শুনেছ ?
                    কিবা অপরূপ গল্প !”

সাহেব কহেন   “আরে ম’লো ! আগে
                   বলতেই দাও গোড়াটা !
মোসাহেব বলে, “আহা-হা গোড়াটা !
                    হুজুরের গোড়া ! এই, চুপ, চুপ ছোঁড়াটা !”

সাহেব কহেন,   “কি বলছিলাম,
                    গোলমালে গেল গুলায়ে !”
মোসাহেব বলে, “হুজুরের মাথা ! গুলাতেই হবে !
                    দিব কি হস্ত বুলায়ে !”
সাহেব কহেন,  “শোনো না। সেদিন
                   সূর্য উঠেছে সকালে !”
মোসাহেব বলে, “সকালে সূর্য ?
                    আমরা কিন্তু দেখি না কাঁদিলে কোঁকালে !”

সাহেব কহেন,  “ভাবিলাম, যাই,
                   আসি খানিকটা বেড়ায়ে,”
মোসাহেব বলে, “অমন সকাল ! যাবে কোথা বাবা,
                    হুজুরের চোখ এড়ায়ে !”
সাহেব কহেন,  “হ’ল না বেড়ানো,
                   ঘরেই রহিনু বসিয়া !”
মোসাহেব বলে, “আগেই বলেছি ! হুজুর কি চাষা,’
                    বেড়াবেন হাল চষিয়া ?”

সাহেব কহেন,  “বসিয়া বসিয়া
                   পড়েছি কখন ঝিমায়ে !”
মোসাহেব বলে, “এই চুপ সব !
                    হুজুর ঝিমান ! পাখা কর্, ডাক্ নিমাইএ !”
সাহেব কহেন,  “ঝিমাইনি, কই
                   এই ত জেগেই রয়েছি।”
মোসাহেব বলে, “হুজুর জেগেই রয়েছেন, তা
                    আগেই সবারে কয়েছি !”
সাহেব কহেন,  “জাগিয়া দেখিনু, জুটিয়াছে যত
                      হনুমান আর অপদেব !”
“হুজুরের চোখ, যাবে কোথা বাবা ?”
                      প্রণমিয়া কয় মোসাহেব।।

>…
বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস্ করলে তাড়া,
বলি থাম্ একটু দাঁড়া।
পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোথা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গ্যে যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি,
ও বাবা, মড়াৎ করে
পড়েছি সড়াৎ জোরে !
পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই,
সে ছিল গাছের আড়েই।

ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার,
ধুমাধুম গোটা দুচ্চার
দিলে খুব কিল ও ঘুসি
একদম জোরসে ঠুসি !
আমিও বাগিয়ে থাপড়
দে হাওয়া চাগিয়ে কাপড়
লাফিয়ে ডিঙনু দেয়াল,
দেখি এক ভিটরে শেয়াল !
আরে ধ্যাৎ শেয়াল কোথা ?
ভোলাটা দাঁড়িয়ে হোথা !
দেখে যেই আঁতকে ওঠা
কুকুরও জুড়লে ছোটা !
আমি কই কম্ম কাবার
কুকুরেই করবে সাবাড় !
‘বাবা গো মা গো’ বলে
পাঁচিলের ফোঁকল গলে
ঢুকি গ্যে বোসদের ঘরে,
যেন প্রাণ আসলো ধরে !
যাব ফের ? কান মলি ভাই,
চুরিতে আর যদি যাই !
তবে মোর নামই মিছা !
কুকুরের চামড়া খিঁচা
সে কি ভাই যায় রে ভুলা–
মালীর ঐ পিটনিগুলা !
কি বলিস্ ? ফের হপ্তা !
তৌবা–নাক খপতা !

>…

    কাঠবেরালি ! কাঠবেরালি ! পেয়ারা তুমি খাও ?
    গুড়-মুড়ি খাও ? দুধ-ভাত খাও ? বাতাবি-নেবু ? লাউ ?
        বেরাল-বাচ্চা ? কুকুর-ছানা ? তাও-
        ডাইনি তুমি হোঁৎকা পেটুক,
        খাও একা পাও যেথায় যেটুক!
        বাতাবি-নেবু সকলগুলো
        একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো!
    তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস্ পাটুস্ চাও ?
    ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার! যাও!

    কাঠবেরালি! বাঁদরীমুখী! মারবো ছুঁড়ে কিল ?
    দেখবি তবে ? রাঙাদা’কে ডাকবো ? দেবে ঢিল!
        পেয়ারা দেবে ? যা তুই ওঁচা!
        তাই তো তোর নাকটি বোঁচা!
        হুত্মো-চোখী! গাপুস গুপুস্
        একলাই খাও হাপুস্ হুপুস!
    পেটে তোমার পিলে হবে! কুড়ি-কুষ্টি মুখে!
    হেই ভগবান! একটা পোকা যাস্ পেটে ওর ঢুকে!
    ইস্! খেয়ো না মস্তপানা ঐ সে পাকাটাও!
    আমিও খুবই পেয়ারা খাই যে! একটি আমায় দাও!

    কাঠবেরালি! তুমি আমার ছোড়দি’ হবে ? বৌদি হবে ? হুঁ!
    রাঙা দিদি ? তবে একটা পেয়ারা দাও না! উঃ!
        এ রাম! তুমি ন্যাংটা পুঁটো ?
        ফ্রকটা নেবে ? জামা দুটো ?
        আর খেয়ো না পেয়ারা তবে,
        বাতাবি-নেবুও ছাড়তে হবে!
    দাঁত দেখিয়ে দিচ্ছ যে ছুঠ? অ’মা দেখে যাও!-
    কাঠবেরালি! তুমি মর! তুমি কচু খাও!!

>…

. বল বীর—
. বল উন্নত মম শির !
শির নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রীর !
. বল বীর—
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
. চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
. ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,
. খোদার আসন “আরশ” ছেদিয়া
. উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর !
মম ললাটে রুদ্র-ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর !
. বল বীর—
. আমি চির-উন্নত শির !

আমি চিরদুর্দ্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাক্লোন, আমি ধ্বংস,
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর !
. আমি দুর্ব্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার !
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল !
আমি মানি নাকো কোনো আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম,
. ভাসমান মাইন !
আমি ধূর্জ্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর !
আমি বিদ্রোহী আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর !
. বল বীর—
. চির উন্নত মম শির !

আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণী,
আমি পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণী !
আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ |
আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি চল-চঞ্চল, ঠুমকি’ ছমকি’
. পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’
. ফিং দিয়া দিই তিন দোল্ !
আমি চপলা-চপল হিন্দোল !

আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা’,
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পঞ্জা,
. আমি উদ্দাম, আমি ঝঞ্ঝা !
আমি মহামারী, আমি ভীতি এ ধরিত্রীর |
আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর |
. বল বীর—
. আমি চির-উন্নত শির !

. আমি চির-দুরন্ত-দুর্ম্মদ,
আমি দুর্দ্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দ্দম্ হ্যায়্ হর্দ্দম্
. ভরপুর মদ |
আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক, জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি !
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান |
আমি ইন্দ্রাণি-সূত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য্য,
মম এক হাতে-বাঁকা ভাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য্য |
আমি কৃষ্ণ-কণ্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির |
আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর |
. বল বীর—
. চির উন্নত মম শির |

আমি সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক !
আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনা ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ !
আমি বজ্র, আমি ঈশাণ-বিষাণে ওঙ্কার,
আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার,
আমি পিনাক-পাণির ডমরু-ত্রিশূল, ধর্ম্মরাজের দণ্ড,
আমি চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ-প্রচণ্ড !
আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা-বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব !
আমি প্রাণ-খোলা-হাসি উল্লাস,— আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস,
আমি মহা-প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস !
আমি কভু প্রশান্ত,— কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্প-হারী !
আমি প্রভঞ্জনের উচ্ছাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল,
আমি উজ্জ্বল আমি প্রোজ্জ্বল,
আমি উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল্ দোল !

আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি,
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম-উদ্দাম, আমি ধন্যি |
আমি উন্মন মন উদাসীর,
আমি বিধাতার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর !
আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয়-লাঞ্ছিত
. বুকে গতি ফের !
আমি অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,
চিত- চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর !
আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক’রে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা’র কাঁকন-চুড়ির কন্-কন্ |
আমি চির-শিশু, চির-কিশোর,
আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর !
আমি উত্তর-বায়ু, মলয়-অনিল, উদাসী পূরবী হাওয়া,
আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীনে গান গাওয়া!
আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র রবি,
আমি মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি!—
আমি তুরিয়ানন্দে ছুটে চলি এ কি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে
. সব বাঁধ !

আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন,
আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব বিজয় কেতন !
ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া
. স্বর্গ-মর্ত্ত্য করতলে,
. তাজি বোরবাক্ আর উচ্চৈস্রবা বাহন আমার
. হিম্মত-হ্রেস্বা হেঁকে চলে !
আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্নি, কালানল,
আমি পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথার-কলরোল-কল-কোলাহল !
আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া, দিয়া লম্ফ,
আণি ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা, সঞ্চরি’ ভূমি-কম্প !
. ধরি বাসুকির ফণা জাপটি’,—
ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি’ !
. আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল,
আমি ধৃষ্ট আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল !

. আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
. মহা- সিন্ধু উতলা ঘুম্-ঘুম্
. ঘুম্ চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্ঝুম্
. মম বাঁশরী তানে পাশরি’
. আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী |
আমি রুষে উঠে’ যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে সপ্ত নরক হারিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া !
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া !

আমি প্লাবন-বন্যা,
কভু ধরণীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা—
আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা !
আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণি !
আমি ছিন্নমস্তা চণ্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি !

আমি মৃণ্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয় !
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
. বিশ্বের আমি চির দুর্জ্জয়,
. জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি এ স্বর্গ-পাতাল-মর্ত্ত্য
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ !!
আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে
. সব বাঁধ !!
আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার,
. নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার !
আমি হল বলরাম স্কন্ধে,
আমি উপাড়ি’ ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে |

. মহা- বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
. আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উত্পীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাশে ধ্বনিবে না,
. অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে কণিবে না—
. বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
. আমি আমি সেই দিন হব শান্ত !
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব-ভিন্ন !
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন !
. আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন !

. আমি চির-বিদ্রোহী বীর—
আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির !

>…

আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু
. এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!
সাত— সাত শ’ নরক-জ্বালা জ্বলে মম ললাটে,
মম ধূম-কুণ্ডলী ক’রেছে শিবের ত্রিনয়ন ঘন ঘোলাটে!
আমি অশিব তিক্ত অভিশাপ,
আমি স্রষ্টার বুকে সৃষ্টি-পাপের অনুতাপ-তাপ-হাহাকার—
. আর মর্ত্তে সাহারা-গোবী ছাপ,
. আমি অশিব তিক্ত অভিশাপ!

আমি সর্ব্বনাশের ঝাণ্ডা উড়ায়ে বোঁও বোঁও ঘুরি শূণ্যে,
আমি বিষ-ধূম-বাণ হানি একা ঘিরে ভগবান-অভিমুন্যে |
শোঁও শন-নন-নন শন-নন-নন শাঁই শাঁই,
. ঘুর্ পাক্ খাই, ধাই পাঁই পাঁই,
. মম পুচ্ছে জড়ায়ে সৃষ্টি ;
. করি’ উল্কা-অশনি-বৃষ্টি, —
আমি একটা বিশ্ব গ্রাসিয়াছি, পারি গ্রাসিতে এখনো ত্রিশটি |
আমি অপঘাত দুর্দ্দৈব রে আমি সৃষ্টির অনাসৃষ্টি!

আমি আপনার বিষ-জ্বালা মদ-পিয়া মোচড় খাইয়া খাইয়া
. জোর বুঁদ হ’য়ে আমি চ’লেছি ধাইয়া ভাইয়া!
. শুনি’ মম বিষাক্ত, “রিরিরিরি”-নাদ
শোনায় দ্বিরেফ-গুঞ্জন সম বিশ্ব ঘোরার প্রণব নিনাদ!
. মম ধূর্জ্জটী-শিখ করাল পুচ্ছে
দশ অবতারে বেঁধে ঝ্যাটা ক’রে ঘোরাই উচ্চে, ঘুরাই—
. আমি অগ্নি কেতন উড়াই! —
আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু
. এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!

ঐ বামন বিধি সে আমারে ধরিতে বাড়ায়েছিল রে হাত
মম অগ্নি-দাহনে জ্ব’লে পুড়ে তাই ঠুঁটো সে জগন্নাথ!
আমি জানি জানি ঐ স্রষ্টার ফাঁকি, সৃষ্টির ঐ চাতুরী,
তাই বিধি ও নিয়মে লাথি মেরে, ঠুকি বিধাতার বুকে হাতুড়ি |
আমি জানি জানি ঐ ভুয়ো ঈশ্বর দিয়ে যা’ হয়নি হবে তা’ও!
তাই বিপ্লব হানি বিদ্রোহ করি, নেচে নেচে দিই গোঁফে তা’ও!
তোর নিযুত নরকে ফুঁ দিয়ে নিবাই, মৃত্যুর মুখে থুতু দি’!
আর যে যত রাগে রে তারে তত কাল্-আগুনের কাতুকুতু দি’!
মম তুরীয় লোকের তির্যক-গতি তূর্য্য-গাজন বাজায়!
মম বিষ-নিঃশ্বাসে মারীভয় হানে অরাজক যত রাজায়!

কচি শিশু-রসনায় ধানী-লঙ্কার পোড়া ঝাল
আর বদ্ধ কারায় গন্ধক ঘোঁয়া, এসিড, পটাস, মোনছাল,
আর কাঁচা কলিজায় পচা ঘা’র সম সৃষ্টিরে আমি দাহ করি
. আর স্রষ্টারে আমি চুষে খাই!
পেলে বাহান্ন-শও জাহান্নামেও আধা চুমুকে সে শুষে যাই!

আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু
. এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!

আমি শি শি শি প্রলয়-শিশ্ দিয়ে ঘুরি কৃতিঘ্নী
. ঐ বিশ্বমাতার শোকাগ্নি,
আমি ত্রিভুবন তার পোড়ায়ে মারিয়া আমিই করিব মুখাগ্নি!
তাই আমি ঘোর তিক্ত সুখে রে, একপাক ঘু’রে বোঁও করে
. ফের দু’পাক নি’!
. কৃতিঘ্নী আমি কৃতিঘ্নী ঐ বিশ্বমাতার শোকাগ্নি!
. পঞ্জর মম খর্পরে জ্বলে নিদারুণ যেই বৈশ্বানর—
. শোন্ রো মর, শোন্ অমর! —
. সে যে তোদের ঐ বিশ্বপিতার চিতা!
এ চিতাগ্নিতে জগদীশ্বর পুড়ে ছাই হবে, হে সৃষ্টি জান কি তা ?
কি বল ? কি বল ? ফের বল ভাই আমি শয়তান-মিতা!
হো হো ভগবানে আমি পোড়াব বলিয়া জ্বালিয়েছি বুকে চিতা!
. ছোট শন শন শন ঘর ঘর ঘর সাঁই সাঁই!
. ছোট পাঁই পাঁই |
তুই অভিশাপ তুই শয়তান তোর অনন্তকাল পরমাই!
. ওরে ভয় নাই তোর মার নাই !!
. তুই প্রলয়ঙ্কর ধূমকেতু!

আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু
. এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!

ঐ ঈশ্বর-শির উল্লঙ্ঘিতে আমি আগুনের সিড়ি,
আমি বসিব বলিয়া পেতেছি ভবানী ব্রহ্মার বুকে পিঁড়ি!
ক্ষ্যাপা মহেশের বিক্ষিপ্ত পিনাক, দেবরাজ-দম্ভোলি
লোকে বলে মোরে, শুনে হাসি আমি আর নাচি বব-বম্ বলি!
এই শিখায় আমার নিযুত ত্রিশূল বাশুলি বজ্র-ছড়ি
ওরে ছড়ানো র’য়েছে, কত যায় গড়াগড়ি!
মহা সিংহাসনে সে কাঁপিছে বিশ্ব-সম্রাট নিরবধি,
তার ললাটে তপ্ত অভিশাপ ছাপ এঁকে দিই আমি যদি!
তাই টিটকিরি দিয়ে হাহা হেসে উঠি,
সে হাসি গুমরি লুটায়ে পরে রে তুফান ঝঞ্ঝা সাইক্লোনে টুটি’ !

আমি বাজাই আকাশে তালি দিয়া “তাতা-উর্ তাক্” |
আর সোঁও সোঁও করে প্যাঁচ দিয়ে খাই চিলে-ঘুড়ি সম ঘুরপাক!
মম নিঃশ্বাস আভাসে অগ্নি-গিরির বুক ফেটে উঠে ঘুত্কারপ
আর পুচ্ছে আমার কোটি নাগ-শিশু উদ্গারে বিষ-ফুত্কার!
কাল বাঘিনী যেমন ধরিয়া শিকার
. তখনি রক্ত শোষে না রে তার,
. দৃষ্টি-সীমায় রাখিয়া তাহারে উগ্রচণ্ড সুখে
. পুচ্ছ সাপটি’ খেলা করে আর শিকার মরে সে ধুঁকে!
. তেমনি করিয়া ভগবানে আমি
. দৃষ্টি-সীমায় রাখি দিবাযামী
ঘিরিয়া ঘিরিয়া খেলিতেছি খেলা, হাসি’ পিশাচের হাসি
এই অগ্নি-বাঘিনী আমি সে সর্ব্বনাশী!

আজ রক্ত মাতাল উল্লাসে মাতি রে—
মম পুচ্ছে ঠিকরে দশগুণ ভাতি,
. রক্ত-রুদ্র উল্লাসে মাতি রে!
ভগবান্ ? সে ত হাতের শিকার!— মুখে ফেনা উঠে মরে!
ভয়ে কাঁপিছে, কখন পড়ি গিয়া তার আহত বুকের প’রে!
. অথবা যেন রে অসহায় এক শিশুরে ঘিরিয়া
. অজগর কাল কেউটা সে কোনা ফিরিয়া ফিরিয়া
. চায়, আর ঘোরে শন্ শন্ শন্,
. ভয় বিহ্বল শিশু তার মাঝে কাঁপে রে যেমন—
. তেমনি করিয়া ভগবানে ঘিরে
. ধূমকেতু-কালনাগ অভিশাপ ছুটে চলেছি রে ;
. আর সাপে-ঘেরা অসহায় শিশু সম
. বিধাতা তোদের কাঁপিছে রুদ্র ঘুর্ণীর মাঝে মম!
. আজিও ব্যথিত সৃষ্টির বুকে ভগবান কাঁদে ত্রাসে,
. স্রষ্টার চেয়ে সৃষ্ট পাছে বা বড় হ’য়ে তারে গ্রাসে!

>…
যাত্রীরা রাত্তিরে হ’তে এল খেয়া পার,
বজ্রেরি তুর্য্যে এ গর্জ্জেছে কে আবার ?
প্রলয়েরি আহ্বান ধ্বনিল কে বিষাণে
ঝঞ্ঝা ও ঘন দেয়া স্বনিল রে ঈশানে!

নাচে পাপ-সিন্ধুতে তুঙ্গ তরঙ্গ!
মৃত্যুর মহানিশা রুদ্র উলঙ্গ!
নিঃশেষে নিশাচর গ্রাসে মহাবিশ্বে,
ত্রাসে কাঁপে তরণীর পাপী যত নিঃস্বে!

তমসাবৃতা ঘোরা “কিয়ামত” রাত্রি,
খেয়া-পারে আশা নাই ডুবিল রে যাত্রী
দমকি দমকি দেয়া হাঁকে কাঁপে দামিনী,
শিঙ্গার হুঙ্কারে থর থর যামিনী!

লঙ্ঘি এ সিন্ধুরে প্রলয়ের নৃত্যে
ওগো কার তরী ধায় নির্ভিক চিত্তে—
অবহেলি ‘ জলধির ভৈরব গর্জ্জন
প্রলয়ের ডঙ্কার ওঙ্কার তর্জ্জন!

পুণ্য পথের এ যে যাত্রীরা নিষ্পাপ,
ধর্ম্মেরি বর্ম্মে সু-রক্ষিত দিল্-সাফ!
নহে এরা শঙ্কিত বজ্র নিপাতে ও
কাণ্ডারী আহমদ তরী ভরা পাথেয়!

আবুবকর্ উসমান উমর আলী হায়দর
দাঁড়ী যে তরুণীর, নাই ওরে নাই ডর!
কাণ্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা,
দাঁড়ী মুখে সারি গান — লা শরীক আল্লাহঃ!

“শাফায়ত্”-পাল-বাঁধা তরণীর মাস্তুল,
“জান্নৎ” হ’তে ফেলে হুরী রাশ্ রাশ্ ফুল!
শিরে নত স্নেহ-আঁখি মঙ্গল-দাত্রী,
গাও জোরে সারি-গান ও-পারের যাত্রী!
বৃথা ত্রাসে প্রলয়ের সিন্ধু ও দেয়া-ভার,
ঐ হ’লো পুণ্যের যাত্রীরা খেয়া পার |

>…

. তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !
. তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !!
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল্-বোশেখীর ঝড় !
. তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !
. তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !!

আসছে এবার অনাগত প্রলয়-নেশার নৃত্য-পাগল,
সিন্ধু-পারের সিংহ-দ্বারে ধমক হেনে ভাঙল আগল !
. মৃত্যু-গহন অন্ধকূপে
. মহাকালের চণ্ড-রূপে—
বজ্র-শিখার মশাল জ্বেলে আসছে ভয়ঙ্কর !
. ওরে ঐ হাসছে ভয়ঙ্কর !
. তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !
. তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !!

ঝামর তাহার কেশের দোলার ঝাপটা মেরে গগন দুলায়,
সর্ব্বনাশী জ্বালা-মুখী ধূমকেতু তার চামর ঢুলায় !
. বিশ্বপাতার বক্ষ-কোলে
. রক্ত তাহার কৃপাণ ঝোলে
. দোদুল দোলে !
অট্টরোলের হট্টোগোলে স্তব্ধ চরাচর—
. ওরে ঐ স্তব্ধ চরাচর !
. তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !
. তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !!

দ্বাদশ-রবির বহ্নি-জ্বালা ভয়াল তাহার নয়ন-কটায়,
দিগন্তরের কাঁদন লুটায় পিঙ্গ তার ত্রস্ত জটায় !
. বিন্দু তাহার নয়ন-জলে
. সপ্ত মহা-সিন্ধু দোলে
. কপোল-তলে !
বিশ্ব-মায়ের আসন তারি বিপুল বাহুর ‘পর—
. হাঁকে ঐ “জয় প্রলয়ঙ্কর !”
. তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !
. তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !!

মাভৈঃ মাভৈঃ ! জগৎ জুড়ে প্রলয় এবার ঘনিয়ে আসে !
জরায় মরা মুমূর্ষুদের প্রাণ-লুকানো ঐ বিনাশে !
. এবার মহা-নিশার শেষে
. আসবে ঊষা অরুণ হেসে
. করুণ বেশে |
দিগম্বরের জটায় লুটায় শিশু চাঁদের কর,
. আলো তার ভরবে এবার ঘর !
. তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !
. তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !!

ঐ যে মহাকাল সারথি রক্ত-তড়িত চাবুক হানে,
রণিয়ে ওঠে হ্রেষার কাঁদন বজ্র-গানে ঝড় তুফানে !
ক্ষুরের দাপট তারায় লেগে উল্কা ছুটায় নীল খিলানে |
. গগন-তলের নীল খিলানে !
. অন্ধ কারার অন্ধ কূপে
. দেবতা বাঁধা যজ্ঞ-যূপে
. পাষাণ-স্তূপে !
এই ত রে তার আসার সময় ঐ রথ-ঘর্ঘর—
. শোনা যায় ঐ রথ-ঘর্ঘর !
. তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !
. তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !!

ধ্বংশ দেখে ভয় কেন তোর ? — প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন |
আসছে নবীন—জীবন-হারা অ-সুন্দরে করতে ছেদন |
. তাই সে এমন কেশে বেশে
. প্রলয় ব’য়েও আসছে হেসে—
. মধুর হেসে !
ভেঙে আবার গ’ড়তে জানে সে চির-সুন্দর !
. তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !
. তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !!

ঐ ভাঙা-গড়া খেলা যে তার কিসের তরে ডর ?
. তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !—
. বধূরা প্রদীপ তুলে ধর !
কাল ভয়ঙ্করের বেশে এবার ঐ আসে সুন্দর !—
. তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !
. তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !

>…

দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার!
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভূলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যত।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার!!

তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান!
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে, নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার!!

অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানেনা সন্তরণ,
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!

গিরি-সংকট, ভীরু যাত্রীরা, গুরু গরজায় বাজ,
পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ
কান্ডারী! তুমি ভূলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?
‘করে হানাহানি, তবু চল টানি’, নিয়াছ যে মহাভার!

কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
বাঙ্গালীর খুনে লাল হ’ল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।

ফাঁসির মঞ্চে যারা গেয়ে গেল জীবনের জয়গান,
আসি’ অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন বলিদান?
আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রান?
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুঁশিয়ার!

(কৃষ্ণনগর; ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৩)

>…

অগণিত মানবের শ্রান্তি-হীন
অসহায় অশান্ত- রোদন,ভেসে আসে মোর কানে
নিশীথের বাণীহীন নিস্তব্ধ অন্ধকারে
ধরণীর দশদিক হতে,
চমকিয়া উঠে মোর ধ্যানের কৈলাসে
মহামণি যোগিন্দ্র শীব।
কোটি শাখা বাহু মেলি আকাশের পানে
যেমন আশ্রয় মাগে বন তরুলতা
কালবৈশাখীর ঝড়ে,দূর্যোগে নিশীথে
পৃথিবীর মাতৃক্রোড়
সহস্র শিকড় দিয়া আঁকড়িয়া কাঁদে
দেশে দেশে কাঁদিছে মোর আত্মার আত্মীয়
আমারই স্রষ্টার সৃষ্ট জীব
সে কোন জন্মের মোর
ভূলে যাওয়া পুত্র কন্যা
পিতা মাতা ভাই বোন
তেমনি করুণ রবে আর্ত ঝংকার তোলে
তাহাদের বিপুল রোদনধ্বণি
হৃদয়ের নীরব তন্ত্রিতে
গভীর প্রশান্তি মোর উদ্বেলিয়া উঠে
সমাধি শয্যায় শুনি,জীবন্ত সমাধি ভীত
মানবের অসীম আকুল হাহাকার
সরোষে ভাঙ্গিতে চাই সমাধির কারা
তপস্যার বল্মীক স্তুপ
পরম একাকী যেই জন
রাখিয়াছে মোরে একাকী করিয়া
ছিন্ন করি সর্ব মানবের সঙ্গ হতে
উচ্চস্বরে ডাকি সেই মহাকালে
হে রুদ্র আদেশ দাও
বাহিরে আসার
দ্বারে মোর কাঁদে সর্বহারা
নিপীড়িত জনগণ আত্মীয় স্বজন
পাতাল তলের দৈত্য অসুর দানব
বাহিরিয়া আসিয়াছে ধরণীর সূর্য়ালোকে
মানুষের বেশ ধরি
হরিয়াছে মানুষের অধিকার
লুটিয়াছে সুখ শান্তি
টুটিয়াছে স্নেহ নীড়
হে রুদ্র আদেশ দাও
শান্তি স্বর্গ হতে টেনে দাও ফেলে
ধরণীর ধূলিতলে
আমারে মরিতে দাও
সর্বঅবমানিতের সাথে।
হেরিনু মৌন শীব মৃদু মৃদু হাসে
শক্তি সাথে অটল কৈলাসে
ধূর্জটির ললাটের বহ্নিশিখা মাঝে
জাগিছে যোগেশ্বরী
মহাশক্তি রক্তচামুন্ডা রুপ ধরি
যেন রক্ত মহাসিন্ধু
সেই প্রলয়ের রক্ত সিন্ধু ম্লান করি
উদিতেছে নব প্রভাতের সূর্য নারায়ণ
সংগ্রাম শশ্মানে আসে যেন
দলে দলে বিভূতি তিলক পড়ি
আঁধারের কারামুক্ত দেব ও সেনাদল
প্রণতি জানায় সবে
নব প্রভাতের নর নারায়ণে।

>

গাহি সাম্যের গান–
মানুষের চেয়ে কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান ,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি ।
‘পুজারী, দুয়ার খোল,
ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পুজার সময় হলো !’
স্বপ্ন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয়
দেবতার বরে আজ রাজা-টাজা হয়ে যাবে নিশ্চয় !
জীর্ণ-বস্ত্র শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুধায় কন্ঠ ক্ষীণ
ডাকিল পান্থ, ‘দ্বার খোল বাবা, খাইনা তো সাত দিন !’
সহসা বন্ধ হল মন্দির , ভুখারী ফিরিয়া চলে
তিমির রাত্রি পথ জুড়ে তার ক্ষুধার মানিক জ্বলে !
ভুখারী ফুকারি’ কয়,
‘ঐ মন্দির পুজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয় !’
মসজিদে কাল শিরনী আছিল, অঢেল গোস্ত রুটি
বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটিকুটি !
এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে-আজারির চিন্
বলে, ‘বাবা, আমি ভুখা ফাকা আছি আজ নিয়ে সাত দিন !’
তেরিয়াঁ হইয়া হাঁকিল মোল্লা–“ভ্যালা হলো দেখি লেঠা,
ভুখা আছ মর গে-ভাগাড়ে গিয়ে ! নামাজ পড়িস বেটা ?”
ভুখারী কহিল, ‘না বাবা !’ মোল্লা হাঁকিল- ‘তা হলে শালা
সোজা পথ দেখ !’ গোস্ত-রুটি নিয়া মসজিদে দিল তালা !
ভুখারী ফিরিয়া চলে,
চলিতে চলিতে বলে–
“আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তেমায় কভু,
আমার ক্ষুধার অন্ন তা’বলে বন্ধ করোনি প্রভু !
তব মজসিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী !”

কোথা চেঙ্গিস, গজনী-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড় ;
ভেঙ্গে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া-দ্বার !
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায় কে দেয় সেখানে তালা ?
সব দ্বার এর খোলা র’বে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা !
হায় রে ভজনালয়
তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয় !
মানুষেরে ঘৃণা করি
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি
ও মুখ হইতে কেতাব-গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে ।
পুজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল !–মুর্খরা সব শোনো
মানুষ এনেছে গ্রন্থ,–গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো ।
আদম দাউদ ঈসা মুসা ইব্রাহিম মোহাম্মদ
কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবীর,-বিশ্বের সম্পদ,
আমাদেরি এরা পিতা পিতামহ, এই আমাদের মাঝে
তাঁদেরি রক্ত কম-বেশী করে প্রতি ধমনীতে বাজে !
আমরা তাঁদেরি সন্তান , জ্ঞাতি , তাঁদেরি মতন দেহ
কে জানে কখন মোরাও অমনি হয়ে যেতে পারি কেহ ।
হেস না বন্ধু ! আমার আমি সে কত অতল অসীম
আমিই কি জানি কে জানে কে আছে আমাতে মহামহিম ।
হয়ত আমাতে আসিছে কল্কি, তোমাতে মেহেদি ঈসা,
কে জানে কাহার অন্ত ও আদি, কে পায় কাহার দিশা ?
কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই, কাহারে মারিছ লাথি ?
হয়তো উহারই বুকে ভগবান জাগিছেন দিবারাতি !
অথবা হয়ত কিছুই নহে সে, মহান উচ্চ নহে,
আছে ক্লেদাক্ত ক্ষত-বিক্ষত পড়িয়া দুঃখ – দহে,
তবু জগতের যত পবিত্র গ্রন্থ ভজানালয়
ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয় !

হয়ত ইহারি ঔরসে ভাই ইহারই কুটীর -বাসে
জন্মিছে কেহ-জোড়া নাই যার জগতের ইতিহাসে !
যে বাণী আজিও শোনেনি জগৎ, যে মহাশক্তিধরে
আজিও বিশ্ব দেখেনি–হয়ত আসিছে সে এরই ঘরে !

ও কে ? চন্ডাল ? চমকাও কেন ? নহে ও ঘৃণ্য জীব !
ওই হতে পারে হরিশচন্দ্র, ওই শ্মশানের শিব ।
আজ চন্ডাল, কাল হতে পারে মহাযোগী-সম্রাট,
তুমি কাল তারে অর্ঘ্য দানিবে, করিবে নান্দী পাঠ ।
রাখাল বলিয়া কারে কর হেলা, ও-হেলা কাহারে বাজে !
হয়ত গোপনে ব্রজের গোপাল এসেছে রাখাল সাজে !
চাষা বলে কর ঘৃণা !
দেখো চাষা রুপে লুকায়ে জনক বলরাম এলো কি না !
যত নবী ছিল মেষের রাখাল, তারও ধরিল হাল
তারাই আনিল অমর বাণী–যা আছে র’বে চিরকাল ।
দ্বারে গালি খেয়ে ফিরে যায় নিতি ভিখারী ও ভিখারিনী,
তারি মাঝে কবে এলো ভোলা -নাথ গিরিজায়া, তা কি চিনি !
তোমার ভোগের হ্রাস হয় পাছে ভিক্ষা-মুষ্টি দিলে
দ্বার দিয়ে তাই মার দিয়ে তুমি দেবতারে খেদাইলৈ ।
সে মোর রহিল জমা –
কে জানে তোমারে লাঞ্ছিতা দেবী করিয়াছে কি না ক্ষমা !
বন্ধু, তোমার বুক-ভরা লোভ দু’চোখ স্বার্থ ঠুলি,
নতুবা দেখিতে, তোমারে সেবিতে দেবতা হয়েছে কুলী ।
মানুষের বুকে যেটুকু দেবতা, বেদনা মথিত সুধা
তাই লুটে তুমি খাবে পশু ? তুমি তা দিয়ে মিটাবে ক্ষুধা ?
তোমার ক্ষুধার আহার তোমার মন্দোদরীই জানে
তোমার মৃত্যু-বাণ আছে তব প্রাসাদের কোনখানে !
তোমারি কামনা-রাণী
যুগে যুগে পশু ফেলেছে তোমায় মৃত্যু বিবরে টানি ।