Archive for the ‘আবু হাসান শাহরিয়ার (১৯৫৯ – )’ Category

>…

নেড়ে দেখলাম, ছেনে দেখলাম,
অসুখ অনাবাদের-
শুশ্রূষা তার আদর।
সংকোচের শীত তাড়াতে
আলিঙ্গনের চাদর
পরিয়ে দিলাম গায়ে।

তোমার পায়ে-পায়ে
শঙ্কা এবং দ্বিধায় ঘোরাফেরা।
একজীবনে এতটা চুলচেরা
হিসেব করা ভালো ?

চুম্বনের জলে তোমায় সিক্ত করি, এসো,
দশ আঙুলে লাঙল দেব বুকে,
আসঙ্গম শরীরময় শৃঙ্গারের বীজ
ছড়িয়ে দেব ঝুঁকে।

কী লাভ বলো ব্রাত্য পড়ে থেকে ?
বাসের যোগ্য যে-জন, তাকে ভিটেয় রাখো তুলে।
এই ভূমিহীন চাষাকে দাও বর্গা চাষের মাটি-
ক্লান্তিহীন প্রেমে ফলাই সুখের খুঁটিনাটি।

>…

‘আকাশ’ লিখতে চন্দ্রবিন্দু বসিয়ে দিলে ‘আ’-এর মাথায়-
লিখলে ‘আঁকাশ’।
বললে হেসে, ‘আজ আঁকাশে চাঁদ উঠেছে।’

এই যে তুমি শব্দাকাশে চাঁদ ওঠালে,
এ চাঁদ কেবল বাঙলা ভাষায় উঠতে পারে।
অন্য ভাষায় এই ঘটনা অনিবর্চন।
তুমিই বলো, তর্জমা হয় এই কবিতার ?
বাঙলা ছাড়া কোন ভাষাতে চন্দ্রবিন্দু হয় বা আছে ?

‘আকাশ’ লিখতে এখন থেকে বিন্দুসমেত চন্দ্র দেব।
শব্দাকাশে উঠুক না চাঁদ।
এখন থেকে ‘আকাশ’ ভুলে ‘আঁকাশ’ লিখব তোমার জন্য।

>…

তোমার চোখের চেয়ে বেশি নীল অন্য কোনও আকাশ ছিল না
যেখানে উড়াল দিতে পারি
তোমার স্পর্শের চেয়ে সুগভীর অন্য কোনও সমুদ্র ছিল না
যেখানে তলিয়ে যেতে পারি
তোমাকে দ্যাখার চেয়ে নির্নিমেষ অন্য কোনও দ্রষ্টব্য ছিল না
যেখানে নিমগ্ন হতে পারি
তোমাকে খোঁজার চেয়ে বেশি দূর অন্য কোনও গন্তব্য ছিল না
যেখানে হারিয়ে যেতে পারি।

কেবল তোমার চেয়ে বেশি দীর্ঘ তুমিহীন একাকী জীবন।

>…

তুমি আমার বহুলপাঠে মুখস্থ এক কাব্যগ্রন্থ-
তোমার প্রতি পঙক্তি আমি পাঠ করেছি মগ্ন হয়ে।
বই কখনো ধার দিতে নেই, জেনেও আমি দিয়েছিলাম-
খুইয়েছি তাই।
ছিঁচকে পাঠক হলেও তোমার গ্রন্থস্বত্ব এখন তারই।

বইচোরা কি কাব্যরসিক ? ছন্দ জানে ?
বই অনেকের বাতিক, ঘরে সাজিয়ে রাখে-
নাকি তেমন হদ্দ নবিশ ?
চোরের ঘরে ধুলোয় মলিন বুকশেলফে কেমন আছো ?

চোর কি জানে, চোর কি জানত,
আমি তোমায় মুখস্থ পাই আদ্যোপান্ত ?

>…

যে আমাকে অস্বীকার করে
প্রথমত অকবি সে; দ্বিতীয়ত পরশ্রীকাতর

হয়তো সে মিডিয়াপালিত কোনও প্রাবন্ধিক; ভুলবাক্যে বুকরিভিউ করে
অথবা সে আসল কালপ্রিট, দ্যাখে বড়কাগজের লঘু সাহিত্য পাতাটি
নতুবা সে ছোট কোনও কাগজের পাতি সম্পাদক
নিজেকে জাহির করে নিজের কাগজে
কাগজে-কাগজে করে সখ্যবিনিময়

ওরা কেউ কবি নয়, ওদের পেছনে ঘুরে বহু প্রতিভাকে আমি নষ্ট হতে দেখি

যে-আমাকে কেবলই স্বীকার করে, বিতর্ক করে না
সে-ও কোনও কবি নয়, জেনো

যে আমাকে গ্রাহ্য করে, পাশাপাশি মধুর তর্কও
তারই মধ্যে আমি কিছু সম্ভাবনা দেখি
সে-ও কবি নয়

কে তাহলে ?

অমিতসম্ভাব্য কবি ভালবাসে একার সন্ন্যাস

>…

মাঠ একা শুয়ে আছে মাঠে
ঘাট বলে, নৌকা ভেড়াও
মেঘের কাঁচুলি খুলে দূরের দিগন্ত ডাকে কাছে
স্তন বলে, মুঠোবন্দি করো
মন বলে, হও বীর্যবান

জীবিকাচাতুর্য আছে; প্রেম নেই তোমাদের কাচের শহরে

ক্ষেমানন্দ অস্ত গেছে, সঙ্গে গেছে খাগের কলম
বেহুলারও ভেলা নেই, লখিন্দর চিতায় উঠেছে
মনসাকে পূজা দিয়ে মুর্চ্ছা গেছে চাঁদসদাগরও
বন্দরে চক্রান্ত, দূরে সারি সারি বর্গীর জাহাজ
পুবের উঠোনে ফের পশ্চিমের ঘুঘুরা নেমেছে
নদীশাসনের তোড়ে মজে গেছে গাঙুরের ধারা
ভাঁড়ারে বর্গীর ছায়া, উঠোনে মনসা তোলে ফণা
কে দেবে পাহারা, বলো, সনকারও ছানিপড়া চোখ
কবির স্বপ্নের ধানে মই দেয় চেঙমুড়ী কানী

চম্পকনগর ভেঙে তৈরি হচ্ছে কাচের শহর

না থাকুক ক্ষেমানন্দ, কবি আমি, ফিরে-ফিরে আসি
যুগে-যুগে আমিই ফিরেছি
বহু বহু যুগ থেকে কতশত অভিজ্ঞতা নিয়ে
আবারও এসেছি ফিরে তোমাদের কাচের শহরে
একদা এখানে ছিল মাঠ-মাঠ চম্পকনগর
এখন কেবলই মরিচিকা

যা ঘটে পুনরাবৃত্তি; পার্থক্য কেবল প্রকরণে

শোনো হে বিভ্রান্ত কাল, কাচের শহরবাসী, শোনো
বলি, শোনো, চন্দ্রধর বণিকের কথা
হাতে যার হেঁতালের লাঠি
চোখে যার গোলাভরা স্বপ্ন রাশি রাশি
শোনো, শোনো, অনাগত কাল
হেঁতালের আতঙ্ক ছিল মনসারও, শোনো
সে-লাঠিতে তিতুমীরও গর্জে উঠেছিল তার বাঁশের কেল্লায়
মুজিবের ডাকে লাঠি ঘরে-ঘরে দুর্গ হয়েছিল

ভাঙো নিদ্রা, জাগো প্রেম, কবি এসে গেছে

এই নাও হেঁতালের লাঠি
মুঠো যেন আলগা কোরো না কোনও উর্দিপরা নাগের ধমকে
এই নাও স্বপ্নমাখা চোখ
ভাঁড়ারে নজর রাখো, হেঁতালে পতাকা হয়ে ওড়ো
এই নাও ভাতমাখা হাত
আমৃত্যু হেঁতালে মাখো তেভাগার রক্তমাখা প্রেম

দেব না দেব না হতে চম্পকনগরে কোনও কাচের শহরে…
চম্পকনগরে কবি কাচের শহর হতে দেবে না দেবে না…

> …

বহুদূরে মানে দূ-উ-উ-রে।
বাড়ির সীমানা,
যত কিছু জানা-
চেনা মাঠ-ঘাট,
অদূরের হাট,
বুড়ো বটমূল-
আর ইশ্কুল-
সব কিছু ছেড়ে অনেকটা পথ ঘুরে
একাই যাচ্ছি, বহুদূরে মানে দূ-উ-উ-রে।

নেই সংশয়,
বাবা-মার ভয়,
স্কুলের শাসন,
স্যারের ভাষণ,
নেই কিছু নেই
তবু তো আছেই
কত কী না-জানা অজানারা চোখ জুড়ে।
একাই যাচ্ছি বহুদূরে মানে দূ-উ-উ-রে।

দেখি নি যে ফুল,
যে নদীর কূল,
নিঝুম বাদাড়,
বুনো ঝোপ-ঝাড়,
আকাশের নীল,
তারা ঝিলমিল-
অবাক তাকিয়ে বাতাসের সুরে সুরে
একাই যাচ্ছি, বহুদূরে মানে দূ-উ-উ-রে।

আরো দূরে ধু-ধু
দিগন্ত শুধু।
আছে তারপরও
ছবি থরোথরো।
দৃশ্যের টানে
মন হার মানে-
তাইতো যাত্রা সব কিছু ছেড়ে-ছুড়ে।
একাই যাচ্ছি বহুদূরে মানে দূ-উ-উ-রে
                   দূ-উ-উ-রে
                   দূ-উ-উ-রে।

>…

সবাই ছিলো ঘুমিয়ে, আমার
দুচোখ ছিলো খোলা-
আকাশ গাঙে শুভ্র চাঁদের
নাও ছিলো পাল-তোলা।
সে-নাও হঠাৎ ভিড়লো আমার
ঘরের নিঝুম ঘাটে,
দরজা খুলে দেখি গলুই
ঠেকেছে চৌকাঠে।
লাফিয়ে চাঁদের পাটাতনে
যেই বসেছি গিয়ে
ঝড়ের বেগে ছুটলো সে-নাও
আমাকে চমকিয়ে।
আকাশ-গাঙে শ্যাওলা নরম
মেঘেরা তুলতুল
দিঘির জলে শাপলা যেমন
তেমনি তারার ফুল।
তারার সে-ফুল একটি আমি
যেই নিয়েছি ছিঁড়ে
অমনি চাঁদের নাওয়ে সটান
ঘরেই এলাম ফিরে।
ঘুম ছিলো ওত পেতেই কাছে
চোখ দু’টোকে ধ’রে
বন্দি করে রাখলো তাদের
মুক্তি দিলো ভোরে।
জেগেই হলাম তারা ফুলের
সন্ধানে উৎসুক-
দেখি আমার মুঠোয় ধরা
মায়ের হাসি মুখ।