Archive for the ‘শঙ্খ ঘোষ (১৯৩২ – )’ Category

>…

লোকে আমায় ভালোই বলে দিব্যি চলনসই
দোষের মধ্যে একটু নাকি মিথ্যে কথা কই।
ঘাটশিলাতে যাবার পথে ট্রেন-ছুটছে যখন
মায়ের কাছে বাবার কাছে করছি বকম বকম।
হঠাৎ দেখি মাঠের মধ্যে চলন্ত সব গাছে
এক একরকম ভঙ্গি ফোটে এক একরকম নাচে।
“ওমা , দেখো নৃত্যনাট্য” -যেই বলেছি আমি
মা বকে দেয় , “বড্ড তোমার বেড়েছে ফাজলামি।”
চিড়িয়াখানার নাম জানো তো আমার সেজ মেসোর
আদর করে দেখিয়ে দিলেন পশুরাজের কেশর।
ক’দিন পরে চুন খসানো দেয়াল জুড়ে এ কী
ঠিক অবিকল সেইরকমই মূর্তি যেন দেখি ?
ক্লাসের মধ্যে যেই বলেছি সুরঞ্জনার কাছে
“জানিস ? আমার ঘরের মধ্যে সিংহ বাঁধা আছে !”
শুনতে পেয়ে দিদিমণি অমনি বলেন “শোন ,
এসব কথা আবার যেন না শুনি কখনো।”
বলি না তাই সে সব কথা সামলে থাকি খুব
কিন্তু সেদিন হয়েছে কি এমনি বেয়াকুব-
আকাশপারে আবার ও চোখ গিয়েছে আটকে
শরৎ মেঘে দেখতে পেলাম রবীন্দ্রনাথকে।

>…

বুঝি তোমার চাউনি বুঝি
থাকবে না আর গলিঘুঁজি
       থাকবে না আর ছাউনি আমার কোথাও
ও প্রমোটার ও প্রমোটার
তোমার হাতে সব ক্ষমতার
       দিচ্ছি চাবি, ওঠাও আমায় ওঠাও |

তুমিই চিরনমস্য, তাই
তোমার পায়ে রত্ন জোটাই
       তোমার পায়েই বিলিয়ে দিই শরীর—
যাঁর যা খুশি বলুন তিনি
করবে তুমি কল্লোলিনী
       ভরসা কেবল কলসি এবং দড়ির |

আমার বলে রইলো শুধু
বুকের ভেতর মস্ত ধু ধু
       দিয়েছি সব যেটুকু ছিল দেবার
ঘর ছেড়ে আজ বাইরে আসি
আমরা কজন অন্তেবাসী
       শবসাধনার রাত কাটাব এবার |

>…

ঈশানে নৈঋতে দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে
মাটির উপর মুখ রেখে
সে এখন শুয়ে আছে শেষ রাতের খোলা প্রান্তরে

আর কেউ নেই
শুধু তার পিঠের দিকে তাকিয়ে আছে লক্ষ লক্ষ তারা

হাতের ডানায় লেগে আছে ঘাসের সবুজ, বুকে ভেজা মাটি এইটুকু ছাতা
যেন কোনো কোমলতা ছিল না কোথাও কোনোখানে

তারপর
আকাশ আর পৃথিবীর ঢাকনা খুলে বেরিয়ে আসে ভোর
এসে দেখে :

যেখানে সে পা দুখানি রেখেছে, সেখানে
কাল বিকেলের শেষ ঝড়ে
পড়ে আছে কুরে খাওয়া সনাতন মহা নিমগাছ |

>…

যা কিছু আমার চার পাশে ছিল
ঘাসপাথর
সরীসৃপ
ভাঙা মন্দির
যা কিছু আমার চার পাশে ছিল
নির্বাসন
কথামালা
একলা সূর্যাস্ত
যা কিছু আমার চার পাশে ছিল
ধ্বংস
তীরবল্লম
ভিটেমাটি
সমস্ত একসঙ্গে কেঁপে ওঠে পশ্চিম মুখে
স্মৃতি যেন দীর্ঘযাত্রী দলদঙ্গল
ভাঙা বাক্স প’ড়ে থাকে আমগাছের ছায়ায়
এক পা ছেড়ে অন্য পায়ে হঠাত সব বাস্তুহীন |

যা কিছু আমার চার পাশে আছে—
শেয়ালদা
ভরদুপুর
উলকি-দেয়াল
যা কিছু আমার চার পাশে আছে—
কানাগলি
স্লোগান
মনুমেন্ট
যা কিছু আমার চার পাশে আছে—
শরশয্যা
ল্যাম্প পোস্ট
লাল গঙ্গা
সমস্ত এক সঙ্গে ঘিরে ধরে মজ্জার অন্ধকার
তার মধ্যে দাঁড়িয়ে বাজে জলতরঙ্গ
চূড়োয় শূণ্য তুলে ধরে হাওড়া ব্রিজ
পায়ের নিচে গড়িয়ে যায় আবহমান |

যা কিছু আমার চার পাশে ঝর্না
উড়ন্ত চুল
উদোম পথ
ঝোড়ো মশাল
যা কিছু আমার চার পাশে স্বচ্ছ
ভোরের শব্ দ
স্নাত শরীর
শ্মশান শিব
যা কিছু আমার চার পাশে মৃত্যু
একেক দিন
হাজার দিন
জন্ম দিন
সমস্ত একসঙ্গে ঘুরে আসে স্মৃতির হাতে
অল্প আলোয় বসে থাকা পথ ভিখারি
যা ছিল আর যা আছে দুই পাথর ঠুকে
জ্বালিয়ে নেয় এতদিনের পুনর্বাসন |

>…

পদ্ম, তোর মনে পড়ে খালযমুনার এপার ওপার
রহস্যনীল গাছের বিষাদ কোথায় নিয়ে গিয়েছিল?

স্পষ্ট নৌকো, ছৈ ছিল না, ভাঙা বৈঠা গ্রাম হারানো
বন্য মুঠোয় ডাগর সাহস, ফলপুলন্ত নির্জনতা

আড়ালবাঁকে কিশোরী চাল, ছিটকে সরে মুখের জ্যোতি
আমরা ভেবেছিলাম এরই নাম বুঝি বা জন্মজীবন |

কিন্তু এখন তোর মুখে কী মৃণালবিহীন কাগজ-আভা
সেদিন যখন হেসেছিলি সত্যি মুখে ঢেউ ছিল না!

আমিই আমার নিজের হাতে রঙিন ক’রে দিয়ে ছিলাম
ছলছলানো মুখোশমালা, সে কথা তুই ভালই জানিস—

তবু কি তোর ইচ্ছে করে আলগা খোলা শ্যামবাজারে
সবার হাতে ঘুরতে-ঘরতে বিন্দু বিন্দু জীবনযাপন?