Archive for the ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ – ১৯৪১)’ Category

>…
তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে গীতহার-
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।

যত শুনি সেই অতীত কাহিনী, প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহমিলন কথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমির রজনী ভেদিয়া তোমারি মুরতি এসে
চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে।

আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে
অনাদি কালের হৃদয় উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে, মিলনমধুর লাজে-
পুরাতন প্রেম নিত্যনতুন সাজে।

আজি সেই চির-দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে,
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।
নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে সকল প্রেমের স্মৃতি-
সকল কালের সকল কবির গীতি।

>…
মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু কখন খেলতে গিয়ে হঠাৎ অকারণে
একটা কী সুর গুনগুনিয়ে কানে আমার বাজে,
মায়ের কথা মিলায় যেন আমার খেলার মাঝে।
মা বুঝি গান গাইত আমার দোলনা ঠেলে ঠেলে-
মা গিয়েছে, যেতে যেতে গানটি গেছে ফেলে।

মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু যখন আশ্বিনেতে ভোরে শিউলিবনে
শিশির-ভেজা হাওয়া বেয়ে ফুলের গন্ধ আসে
তখন কেন মায়ের কথা আমার মনে ভাসে।
কবে বুঝি আনত মা সেই ফুলের সাজি বয়ে-
পূজোর গন্ধ আসে যে তাই মায়ের গন্ধ হয়ে।

মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু যখন বসি গিয়ে শোবার ঘরের কোণে,
জানলা থেকে তাকাই দূরে নীল আকাশের দিকে-
মনে হয় মা আমার পানে চাইছে অনিমিখে।
কোলের পরে ধরে কবে দেখত আমায় চেয়ে,
সেই চাউনি রেখে গেছে সারা আকাশ ছেয়ে।

>…
            মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে
            মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চ’ড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক ক’রে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার ‘পরে
            টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে।
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে
রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে।

            সন্ধে হল, সূর্য নামে পাটে,
            এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে।
ধূ-ধূ করে যে দিক-পানে চাই,
কোনোখানে জনমানব নাই-
তুমি যেন আপন-মনে তাই
             ভয় পেয়েছ; -ভাবছ, ‘এলেম কোথা !’
আমি বলছি, ‘ভয় কোরো না মা গো,
             ওই দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা।’
             চোরকাঁটাতে মাঠ রয়েছে ঢেকে,
             মাঝখানেতে পথ গিয়েছে বেঁকে।
গরু বাছুর নেইকো কোনোখানে,
সন্ধে হতেই গেছে গাঁয়ের পানে,
আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে,
             অন্ধকারে দেখা যায় না ভালো।
তুমি যেন বললে আমায় ডেকে,
             ‘দিঘির ধারে ঐ যে কিসের আলো !’

             এমন সময় ‘হাঁরে রে-রে-রে-রে’,
             ওই যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে।
তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোণে
ঠাকুর-দেব্তা স্মরণ করছ মনে,
বেয়ারাগুলো পাশের কাঁটাবনে
             পালকি ছেড়ে কাঁপছে থরোথরো।
আমি যেন তোমায় বলছি ডেকে,
             ‘আমি আছি, ভয় কেন মা করো !’

             হাতে লাঠি, মাথায় ঝাঁকড়া চুল,
             কানে তাদের গোঁজা জবার ফুল।
আমি বলি দাঁড়া, খবরদার !
এক পা কাছে আসিস যদি আর-
এই চেয়ে দেখ্ আমার তলোয়ার,
             টুকরো ক’রে দেব তোদের সেরে।’
শুনে তারা লম্ফ দিয়ে উঠে
             চেঁচিয়ে উঠল, ‘হাঁরে রে-রে-রে-রে।’

             তুমি বললে, ‘যাস নে খোকা ওরে।’
             আমি বলি, ‘দেখো না চুপ ক’রে।’
ছুটিয়ে ঘোড়া গেলেম তাদের মাঝে,
ঢাল তলোয়ার ঝনঝনিয়ে বাজে,
কী ভয়ানক লড়াই হল মা যে,
             শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা।
কত লোক যে পালিয়ে গেল ভয়ে,
কত লোকের মাথা পড়ল কাটা।

             এত লোকের সঙ্গে লড়াই ক’রে,
             ভাবছ খোকা গেলই বুঝি মরে।
আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে
বলছি এসে, ‘লড়াই গেছে থেমে’।
তুমি শুনে পালকি থেকে নেমে
             চুমো খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে-
বলছ, ‘ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল !
             কী দুর্দশাই হত তা না হলে।’

             রোজ কত কী ঘটে যাহা-তাহা-
             এমন কেন সত্যি হয় না, আহা !
ঠিক যেন এক গল্প হত তবে,
শুনত যারা অবাক হত সবে।
দাদা বলত, ‘কেমন করে হবে,
             খোকার গায়ে এত কি জোর আছে !’
পাড়ার লোকে সবাই বলত শুনে,
             ‘ভাগ্যে খোকা ছিল মায়ের কাছে।’

     

>…
তালগাছ          এক পায়ে দাঁড়িয়ে
                    সব গাছ ছাড়িয়ে
                         উঁকি মারে আকাশে।
মনে সাধ,        কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়
                    একেবারে উড়ে যায়;
                         কোথা পাবে পাখা সে ?
তাই তো সে      ঠিক তার মাথাতে
                    গোল গোল পাতাতে
                    ইচ্ছাটি মেলে তার,-
মনে মনে         ভাবে, বুঝি ডানা এই,
                    উড়ে যেতে মানা নেই
                         বাসাখানি ফেলে তার।

সারাদিন          ঝরঝর থত্থর
                    কাঁপে পাতা-পত্তর,
                         ওড়ে যেন ভাবে ও,
মনে মনে         আকাশেতে বেড়িয়ে
                    তারাদের এড়িয়ে
                          যেন কোথা যাবে ও।
তার পরে         হাওয়া যেই নেমে যায়,
                    পাতা-কাঁপা থেমে যায়,
                          ফেরে তার মনটি
যেই ভাবে,       মা যে হয় মাটি তার
                    ভালো লাগে আরবার
                          পৃথিবীর কোণটি।

>…
আমি আজ কানাই মাস্টার,
           পোড়ো মোর বেড়াল ছানাটি।
আমি ওকে মারি নে মা বেত,
           মিছিমিছি বসি নিয়ে কাঠি।
রোজ রোজ দেরি করে আসে,
           পড়াতে দেয় না ও তো মন,
ডান পা তুলিয়ে তোলে হাই
           যত আমি বলি, ‘শোন্, শোন্’।
দিনরাত খেলা খেলা খেলা,
           লেখা পড়ায় ভারি অবহেলা।
আমি বলি ‘চ ছ জ ঝ ঞ’,
ও কেবল বলে ‘মিয়োঁ’ মিয়োঁ’।


প্রথম ভাগের পাতা খুলে
           আমি ওরে বোঝাই মা, কত-
চুরি করে খাস্ নে কখনো,
           ভালো হোস্ গোপালের মতো।

যত বলি সব হয় মিছে,
           কথা যদি একটিও শোনে-
মাছ যদি দেখেছে কোথাও
           কিছুই থাকে না আর মনে।
চড়াই পাখির দেখা পেলে
           ছুটে যায় সব পড়া ফেলে।
যত বলি ‘চ ছ জ ঝ ঞ’
           দুষ্টুমি করে বলে ‘মিয়োঁ’।
আমি ওরে বলি বার বার
           ‘পড়ার সময় তুমি পোড়ো,-
তার পরে ছুটি হয়ে গেলে
           খেলার সময় খেলা কোরো’।
ভালোমানুষের মতো থাকে,
           আড়ে আড়ে চায় মুখপানে,
এমনি সে ভান করে যেন
           যা বলি বুঝেছে তার মানে।
একটু সুযোগ বোঝে যেই
           কোথা যায় আর দেখা নেই।
আমি বলি ‘চ ছ জ ঝ ঞ’,
           ও কেবল বলে ‘মিয়োঁ মিয়োঁ।

>…

ভূতের মতন চেহারা যেমন,   নির্বোধ অতি ঘোর—
যা‐কিছু হারায়, গিন্নি বলেন,   “কেষ্টা বেটাই চোর।”
উঠিতে বসিতে করি বাপান্ত,   শুনেও শোনে না কানে,
যত পায় বেত না পায় বেতন,   তবু না চেতন মানে।
বড়ো প্রয়োজন, ডাকি প্রাণপণ   চীৎকার করি “কেষ্টা”—
যত করি তাড়া নাহি পাই সাড়া,   খুঁজে ফিরি সারা দেশটা।
তিনখানা দিলে একখানা রাখে,   বাকি কোথা নাহি জানে;
একখানা দিলে নিমেষ ফেলিতে   তিনখানা করে আনে।
যেখানে সেখানে দিবসে দুপুরে   নিদ্রাটি আছে সাধা;
মহাকলরবে গালি দেই যবে   “পাজি হতভাগা গাধা”—
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সে হাসে,   দেখে জ্বলে যায় পিত্ত,
তবু মায়া তার ত্যাগ করা ভার— বড়ো পুরাতন ভৃত্য।

ঘরের কর্ত্রী রুক্ষমূর্তি   বলে, “আর পারি নাকো,
রহিল তোমার এ ঘর‐দুয়ার,   কেষ্টারে লয়ে থাকো।
না মানে শাসন   বসন বাসন   অশন আসন যত
কোথায় কী গেল, শুধু টাকাগুলো   যেতেছে জলের মতো।
গেলে সে বাজার সারা দিনে আর   দেখা পাওয়া তার ভার—
করিলে চেষ্টা কেষ্টা ছাড়া কি   ভৃত্য মেলে না আর!”
শুনে মহা রেগে ছুটে যাই বেগে,   আনি তার টিকি ধরে;
বলি তারে, “পাজি, বেরো তুই আজই,   দূর করে দিনু তোরে।”
ধীরে চলে যায়, ভাবি গেল দায়;   পরদিনে উঠে দেখি,
হুঁকাটি বাড়ায়ে রয়েছে দাঁড়ায়ে   বেটা বুদ্ধির ঢেঁকি—
প্রসন্ন মুখ, নাহি কোনো দুখ,   অতি অকাতর চিত্ত!
ছাড়ালে না ছাড়ে, কী করিব তারে—  মোর পুরাতন ভৃত্য!

সে বছরে ফাঁকা পেনু কিছু টাকা   করিয়া দালালগিরি,
করিলাম মন শ্রীবৃন্দাবন   বারেক আসিব ফিরি।
পরিবার তায় সাথে যেতে চায়,   বুঝায়ে বলিনু তারে—
পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য,   নহিলে খরচ বাড়ে।
লয়ে রশারশি করি কষাকষি   পোঁটলাপুঁটলি বাঁধি
বলয় বাজায়ে বাক্স সাজায়ে   গৃহিণী কহিল কাঁদি,
“পরদেশে গিয়ে কেষ্টারে নিয়ে   কষ্ট অনেক পাবে।”
আমি কহিলাম, “আরে রাম রাম!   নিবারণ সাথে যাবে।”
রেলগাড়ি ধায়; হেরিলাম হায়   নামিয়া বর্ধমানে—
কৃষ্ণকান্ত অতি প্রশান্ত,   তামাক সাজিয়া আনে!
স্পর্ধা তাহার হেনমতে আর    কত বা সহিব নিত্য!
যত তারে দুষি তবু হনু খুশি   হেরি পুরাতন ভৃত্য!

নামিনু শ্রীধামে— দক্ষিণে বামে   পিছনে সমুখে যত
লাগিল পাণ্ডা, নিমেষে প্রাণটা   করিল কণ্ঠাগত।
জন‐ছয়‐সাতে  মিলি এক‐সাথে   পরমবন্ধুভাবে
করিলাম বাসা; মনে হল আশা,   আরামে দিবস যাবে।
কোথা ব্রজবালা কোথা বনমালা,   কোথা বনমালী হরি!
কোথা হা হন্ত, চিরবসন্ত!   আমি বসন্তে মরি।
বন্ধু যে যত স্বপ্নের মতো   বাসা ছেড়ে দিল ভঙ্গ;
আমি একা ঘরে ব্যাধি‐খরশরে   ভরিল সকল অঙ্গ।
ডাকি নিশিদিন সকরুণ ক্ষীণ,   “কেষ্ট আয় রে কাছে।
এত দিনে শেষে আসিয়া বিদেষে   প্রাণ বুঝি নাহি বাঁচে।”
হেরি তার মুখ ভরে ওঠে বুক,    সে যেন পরম বিত্ত—
নিশিদিন ধরে দাঁড়ায়ে শিয়রে   মোর পুরতন ভৃত্য।

মুখে দেয় জল, শুধায় কুশল,   শিরে দেয় মোর হাত;
দাঁড়ায়ে নিঝুম, চোখে নাই ঘুম,   মুখে নাই তার ভাত।
বলে বার বার, “কর্তা, তোমার   কোনো ভয় নাই, শুন—
যাবে দেশে ফিরে, মাঠাকুরানীরে   দেখিতে পাইবে পুন।”
লভিয়া আরাম আমি উঠিলাম;   তাহারে ধরিল জ্বরে;
নিল সে আমার কালব্যাধিভার   আপনার দেহ‐’পরে।
হয়ে জ্ঞানহীন কাটিল দু দিন,   বন্ধ হইল নাড়ী;
এতবার তারে গেনু ছাড়াবারে,  এতদিনে গেল ছাড়ি।
বহুদিন পরে আপনার ঘরে   ফিরিনু সারিয়া তীর্থ;
আজ সাথে নেই চিরসাথি সেই   মোর পুরাতন ভৃত্য।

>


          দূরে বহুদূরে
     স্বপ্নলোকে উজ্জয়িনীপুরে
খুঁজিতে গেছিনু কবে শিপ্রানদীপারে
মোর পূর্বজনমের প্রথমা প্রিয়ারে।
মুখে তার লোধ্ররেণু, লীলাপদ্ম হাতে,
কর্ণমূলে কুন্দকলি, কুরুবক মাথে,
তনু দেহে রক্তাম্বর নীবিবন্ধে বাঁধা,
চরণে নূপুরখানি বাজে আধা আধা।
          বসন্তের দিনে
ফিরেছিনু বহুদূরে পথ চিনে চিনে।

     মহাকালমন্দিরের মাঝে
তখন গম্ভীর মন্দ্রে সন্ধ্যারতি বাজে।
জনশূন্য পণ্যবীথি— ঊর্ধ্বে যায় দেখা
অন্ধকার হর্ম্য‐’পরে সন্ধ্যারশ্মিরেখা।

          প্রিয়ার ভবন
বঙ্কিম সংকীর্ণ পথে দুর্গম, নির্জন।
দ্বারে আঁকা শঙ্খচক্র, তারি দুই ধারে
দুটি শিশু নীপতরু পুত্রস্নেহে বাড়ে।
     তোরণের শ্বেতস্তম্ভ‐’পরে
সিংহের গম্ভীর মূর্তি বসি দম্ভভরে।

প্রিয়ার কপোতগুলি ফিরে এল ঘরে,
ময়ূর নিদ্রায় মগ্ন স্বর্ণদণ্ড‐’পরে।
     হেনকালে হাতে দীপশিখা
ধীরে ধীরে নামি এল মোর মালবিকা।
দেখা দিল দ্বারপ্রান্তে সোপানের’পরে
সন্ধ্যার লক্ষ্মীর মতো সন্ধ্যাতারা করে।
অঙ্গের কুঙ্কুমগন্ধ কেশধূপবাস
ফেলিল সর্বাঙ্গে মোর উতলা নিশ্বাস।
প্রকাশিল অর্ধচ্যুত বসন‐অন্তরে
চন্দনের পত্রলেখা বাম পয়োধরে।
     দাঁড়াইল প্রতিমার প্রায়
নগরগুঞ্জনক্ষান্ত নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়।

          মোরে হেরি প্রিয়া
ধীরে ধীরে দীপখানি দ্বারে নামাইয়া
আইল সম্মুখে, মোর হস্তে হস্ত রাখি
নীরবে শুধালো শুধু, সকরুণ আঁখি,
‘হে বন্ধু, আছ তো ভালো?’ মুখে তার চাহি
কথা বলিবারে গেনু— কথা আর নাহি।
সে ভাষা ভুলিয়া গেছি— নাম দোঁহাকার
দুজনে ভাবিনু কত— মনে নাহি আর।
দুজনে ভাবিনু কত চাহি দোঁহা‐পানে,
অঝোরে ঝরিল অশ্রু নিস্পন্দ নয়ানে।
দুজনে ভাবিনু কত দ্বারতরুতলে।
      নাহি জানি কখন কী ছলে
সুকোমল হাতখানি লুকাইল আসি
আমার দক্ষিণকরে, কুলায়প্রত্যাশী
সন্ধ্যার পাখির মতো; মুখখানি তার
নতবৃন্তপদ্মসম এ বক্ষে আমার
নমিয়া পড়িল ধীরে; ব্যাকুল উদাস
নিঃশব্দে মিলিল আসি নিশ্বাসে নিশ্বাস।

       রজনীর অন্ধকার
উজ্জয়িনী করি দিল লুপ্ত একাকার।
       দীপ দ্বারপাশে
কখন নিবিয়া গেল দুরন্ত বাতাসে।
       শিপ্রানদীতীরে
আরতি থামিয়া গেল শিবের মন্দিরে।

>…

কহিলা হবু, ‘শুন গো গোবুরায়,
         কালিকে আমি ভেবেছি সারা রাত্র—
মলিন ধূলা লাগিবে কেন পায়
         ধরণী‐মাঝে চরণ‐ফেলা মাত্র!
তোমরা শুধু বেতন লহ বাঁটি,
         রাজার কাজে কিছুই নাহি দৃষ্টি।
আমার মাটি লাগায় মোরে মাটি,
         রাজ্যে মোর একি এ অনাসৃষ্টি!
               শীঘ্র এর করিবে প্রতিকার,
               নহিলে কারো রক্ষা নাহি আর।’

শুনিয়া গোবু ভাবিয়া হল খুন,
         দারুণ ত্রাসে ঘর্ম বহে গাত্রে।
পণ্ডিতের হইল মুখ চুন,
         পাত্রদের নিদ্রা নাহি রাত্রে।
রান্নাঘরে নাহিকো চড়ে হাঁড়ি,
         কান্নাকাটি পড়িল বাড়িমধ্যে,
অশ্রুজলে ভাসায়ে পাকা দাড়ি
         কহিলা গোবু হবুর পাদপদ্মে,
               ‘যদি না ধুলা লাগিবে তব পায়ে,
               পায়ের ধুলা পাইব কী উপায়ে!’

শুনিয়া রাজা ভাবিল দুলি দুলি,
         কহিল শেষে, ‘কথাটা বটে সত্য—
কিন্তু আগে বিদায় করো ধুলি,
         ভাবিয়ো পরে পদধুলির তত্ত্ব।
ধুলা‐অভাবে না পেলে পদধুলা
         তোমরা সবে মাহিনা খাও মিথ্যে,
কেন বা তবে পুষিনু এতগুলা
         উপাধি‐ধরা বৈজ্ঞানিক ভৃত্যে?
               আগের কাজ আগে তো তুমি সারো,
               পরের কথা ভাবিয়ো পরে আরো।’

আঁধার দেখে রাজার কথা শুনি,
         যতনভরে আনিল তবে মন্ত্রী
যেখানে যত আছিল জ্ঞানীগুণী
         দেশে বিদেশে যতেক ছিল যন্ত্রী।
বসিল সবে চশমা চোখে আঁটি,
         ফুরায়ে গেল উনিশ পিপে নস্য।
অনেক ভেবে কহিল, ‘গেলে মাটি
         ধরায় তবে কোথায় হবে শস্য?’
               কহিল রাজা, ‘তাই যদি না হবে,
               পণ্ডিতেরা রয়েছ কেন তবে?’

সকলে মিলি যুক্তি করি শেষে
         কিনিল ঝাঁটা সাড়ে সতেরো লক্ষ,
ঝাঁটের চোটে পথের ধুলা এসে
         ভরিয়ে দিল রাজার মুখ বক্ষ।
ধুলায় কেহ মেলিতে নারে চোখ,
         ধুলার মেঘে পড়িল ঢাকা সূর্য।
ধুলার বেগে কাশিয়া মরে লোক,
         ধুলার মাঝে নগর হল উহ্য।
               কহিল রাজা, ‘করিতে ধুলা দূর,
               জগৎ হল ধুলায় ভরপুর!’

তখন বেগে ছুটিল ঝাঁকে ঝাঁক
         মশক কাঁখে একুশ লাখ ভিস্তি।
পুকুরে বিলে রহিল শুধু পাঁক,
         নদীর জলে নাহিক চলে কিস্তি।
জলের জীব মরিল জল বিনা,
         ডাঙার প্রাণী সাঁতার করে চেষ্টা—
পাঁকের তলে মজিল বেচা‐কিনা,
         সর্দিজ্বরে উজাড় হল দেশটা।
               কহিল রাজা, ‘এমনি সব গাধা
               ধুলারে মারি করিয়া দিল কাদা!’

আবার সবে ডাকিল পরামর্শে;
         বসিল পুন যতেক গুণবন্ত—
ঘুরিয়া মাথা হেরিল চোখে সর্ষে,
         ধুলার হায় নাহিক পায় অন্ত।
কহিল, ‘মহী মাদুর দিয়ে ঢাকো,
         ফরাশ পাতি করিব ধুলা বন্ধ।’
কহিল কেহ, ‘রাজারে ঘরে রাখো,
         কোথাও যেন থাকে না কোনো রন্ধ্র।
               ধুলার মাঝে না যদি দেন পা
               তা হলে পায়ে ধুলা তো লাগে না।’

কহিল রাজা, ‘সে কথা বড়ো খাঁটি,
         কিন্তু মোর হতেছে মনে সন্ধ,
মাটির ভয়ে রাজ্য হবে মাটি
         দিবসরাতি রহিলে আমি বন্ধ।’
কহিল সবে, ‘চামারে তবে ডাকি
         চর্ম দিয়া মুড়িয়া দাও পৃথ্বী।
ধূলির মহী ঝুলির মাঝে ঢাকি
         মহীপতির রহিবে মহাকীর্তি।’
               কহিল সবে, ‘হবে সে অবহেলে,
               যোগ্যমতো চামার যদি মেলে।’

রাজার চর ধাইল হেথা হোথা,
         ছুটিল সবে ছাড়িয়া সব কর্ম।
যোগ্যমতো চামার নাহি কোথা,
         না মিলে তত উচিত‐মতো চর্ম।
তখন ধীরে চামার‐কুলপতি
         কহিল এসে ঈষৎ হেসে বৃদ্ধ,
‘বলিতে পারি করিলে অনুমতি,
         সহজে যাহে মানস হবে সিদ্ধ।
               নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে
               ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।’

কহিল রাজা, ‘এত কি হবে সিধে,
         ভাবিয়া ম’ল সকল দেশ‐শুদ্ধ!’
মন্ত্রী কহে, ‘বেটারে শূল বিঁধে
         কারার মাঝে করিয়া রাখো রুদ্ধ।’
রাজার পদ চর্ম‐আবরণে
         ঢাকিল বুড়া বসিয়া পদোপান্তে।
মন্ত্রী কহে, ‘আমারো ছিল মনে
         কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে !’
               সেদিন হতে চলিল জুতা পরা—
               বাঁচিল গোবু, রক্ষা পেল ধরা।

>…

যথার্থ আপন

কুষ্মাণ্ডের মনে মনে বড়ো অভিমান,
বাঁশের মাচাটি তার পুষ্পক বিমান।
ভুলেও মাটির পানে তাকায় না তাই,
চন্দ্রসূর্যতারকারে করে `ভাই ভাই’।
নভশ্চর ব’লে তাঁর মনের বিশ্বাস,
শূন্য-পানে চেয়ে তাই ছাড়ে সে নিশ্বাস।
ভাবে, `শুধু মোটা এই বোঁটাখানা মোরে
বেঁধেছে ধরার সাথে কুটুম্বিতাডোরে;
বোঁটা যদি কাটা পড়ে তখনি পলকে
উড়ে যাব আপনার জ্যোতির্ময় লোকে।’
বোঁটা যবে কাটা গেল, বুঝিল সে খাঁটি—
সূর্য তার কেহ নয়, সবই তার মাটি।

হাতে-কলমে

বোলতা কহিল, এ যে ক্ষুদ্র মউচাক,
এরই তরে মধুকর এত করে জাঁক!
মধুকর কহে তারে, তুমি এসো ভাই,
আরো ক্ষুদ্র মউচাক রচো দেখে যাই।

গৃহভেদ

আম্র কহে, একদিন, হে মাকাল ভাই,
আছিনু বনের মাঝে সমান সবাই;
মানুষ লইয়া এল আপনার রুচি—
মূল্যভেদ শুরু হল, সাম্য গেল ঘুচি।

গরজের আত্মীয়তা

কহিল ভিক্ষার ঝুলি টাকার থলিরে,
আমরা কুটুম্ব দোঁহে ভুলে গেলি কি রে?
থলি বলে, কুটুম্বিতা তুমিও ভুলিতে
আমার যা আছে গেলে তোমার ঝুলিতে।

কুটুম্বিতা

কেরোসিন-শিখা বলে মাটির প্রদীপে,
ভাই ব’লে ডাকো যদি দেব গলা টিপে।
হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা;
কেরোসিন বলি উঠে, এসো মোর দাদা।

উদারচরিতানাম্

প্রাচীরের ছিদ্রে এক নামগোত্রহীন
ফুটিয়াছে ছোটো ফুল অতিশয় দীন।
ধিক্-ধিক্ করে তারে কাননে সবাই;
সূর্য উঠি বলে তারে, ভালো আছো ভাই ?

অসম্ভব ভালো

যথাসাধ্য-ভালো বলে, ওগো আরো-ভালো,
কোন্ স্বর্গপুরী তুমি করে থাকো আলো?
আরো-ভালো কেঁদে কহে, আমি থাকি হায়
অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম ঈর্ষায়।

প্রত্যক্ষ প্রমাণ

বজ্র কহে, দূরে আমি থাকি যতক্ষণ
আমর গর্জনে বলে মেঘের গর্জন,
বিদ্যুতের জ্যোতি বলি মোর জ্যোতি রটে,
মাথায় পড়িলে তবে বলে— `বজ্র বটে!’

ভক্তিভাজন

রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম—
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।
পথ ভাবে `আমি দেব’, রথ ভাবে `আমি’,
মূর্তি ভাবে `আমি দেব’— হাসে অন্তর্যামী।

উপকারদম্ভ

শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির,
লিখে রেখো, এক ফোঁটা দিলেম শিশির।

সন্দেহের কারণ

`কত বড়ো আমি’ কহে নকল হীরাটি,
তাই তো সন্দেহ করি নহ ঠিক খাঁটি।

অকৃতজ্ঞ

ধ্বনিটিরে প্রতিধ্বনি সদা ব্যঙ্গ করে,
ধ্বনি-কাছে ঋণী সে যে পাছে ধরা পড়ে।

নিজের ও সাধারণের

চন্দ্র কহে, বিশ্বে আলো দিয়েছি ছড়ায়ে,
কলঙ্ক যা আছে তাহা আছে মোর গায়ে।

মাঝারির সতর্কতা

উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে,
তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে।

নতিস্বীকার

তপন-উদয়ে হবে মহিমার ক্ষয়,
তবু প্রভাতের চাঁদ শান্তমুখে কয়,
অপেক্ষা করিয়া আছি অস্তসিন্ধুতীরে
প্রণাম করিয়া যাব উদিত রবিরে।

কর্তব্যগ্রহণ

কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি—
শুনিয়া জগত্‍‌ রহে নিরুত্তর ছবি।
মাটির প্রদীপ ছিল; সে কহিল, স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।

ধ্রুবাণি তস্য নশ্যন্তি

রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে, শুধু ব্যর্থ হয় তারা।

মোহ

নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস,
ও পারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।
নদীর ও পার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে—
কহে, যাহা কিছু সুখ সকলই ও পারে।

ফুল ও ফল

ফুল কহে ফুকারিয়া, ফল, ওরে ফল,
কত দূরে রয়েছিস বল্ মোরে বল্!
ফল কহে মহাশয়, কেন হাঁকাহাঁকি—
তোমারই অন্তরে আমি নিরন্তর থাকি।

প্রশ্নের অতীত

হে সমুদ্র, চিরকাল কী তোমার ভাষা?
সমুদ্র কহিল, মোর অনন্ত জিজ্ঞাসা।
কিসের স্তব্ধতা তব ওগো গিরিবর?
হিমাদ্রি কহিল, মোর চিরনিরুত্তর।

মোহের আশঙ্কা

শিশু পুষ্প আঁখি মেলি হেরিল এ ধরা—
শ্যামল, সুন্দর, স্নিগ্ধ, গীতগন্ধ-ভরা;
বিশ্বজগতেরে ডাকি কহিল, হে প্রিয়,
আমি যতকাল থাকি তুমিও থাকিয়ো।

চালক

অদৃষ্টেরে শুধালেম, চিরদিন পিছে
অমোঘ নিষ্ঠুর বলে কে মোরে ঠেলিছে?
সে কহিল, ফিরে দেখো। দেখিলেম থামি,
সম্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের আমি।

>…
    আমার মা না হয়ে তুমি
            আর কারো মা হলে
    ভাবছ তোমায় চিনতেম না,
            যেতেম না ওই কোলে ?
    মজা আরো হত ভারি,
    দুই জায়গায় থাকত বাড়ি,
    আমি থাকতেম এই গাঁয়েতে,
            তুমি পারের গাঁয়ে।
    এইখানেতেই দিনের বেলা
    যা-কিছু সব হত খেলা
    দিন ফুরোলেই তোমার কাছে
            পেরিয়ে যেতেম নায়ে।
    হঠাৎ এসে পিছন দিকে
    আমি বলতেম, “বল্ দেখি কে ?”
    তুমি ভাবতে, চেনার মতো,
            চিনি নে তো তবু।
    তখন কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে
    আমি বলতেম গলা ধরে-
    “আমায় তোমায় চিনতে হবেই,
            আমি তোমার অবু!”

    ওই পারেতে যখন তুমি
            আনতে যেতে জল,-
    এই পারেতে তখন ঘাটে
            বল্ দেখি কে বল্ ?
    কাগজ-গড়া নৌকোটিকে
    ভাসিয়ে দিতেম তোমার দিকে,
    যদি গিয়ে পৌঁছোত সে
            বুঝতে কি, সে কার ?
    সাঁতার আমি শিখিনি যে,
    নইলে আমি যেতেম নিজে,
    আমার পারের থেকে আমি
            যেতেম তোমার পার।
    মায়ের পারে অবুর পারে
    থাকত তফাত, কেউ তো কারে
    ধরতে গিয়ে পেত নাকো,
            রইত না একসাথে।
    দিনের বেলায় ঘুরে ঘুরে
    দেখা-দেখি দূরে দূরে-,
    সন্ধেবেলায় মিলে যেত
            অবুতে আর মা-তে।

    কিন্তু হঠাৎ কোনোদিনে
            যদি বিপিন মাঝি
    পার করতে তোমার পারে
            নাই হত মা রাজি।
    ঘরে তোমার প্রদীপ জ্বেলে
    ছাতের ’পরে মাদুর মেলে
    বসতে তুমি, পায়ের কাছে
            বসত ক্ষান্ত বুড়ি,
    উঠত তারা সাত ভায়েতে,
    ডাকত শেয়াল ধানের খেতে,
    উড়ো ছায়ার মতো বাদুড়
            কোথায় যেত উড়ি।
    তখন কি মা, দেরি দেখে
    ভয় হত না থেকে থেকে,
    পার হয়ে, মা, আসতে হতই
            অবু যেথায় আছে।
    তখন কি আর ছাড়া পেতে ?
    দিতেম কি আর ফিরে যেতে ?
    ধরা পড়ত মায়ের ওপার
            অবুর পারের কাছে।