Archive for the ‘আল মাহমুদ (১৯৩৬ – )’ Category

>…

আমি তোমাকে কতবার বলেছি আমি বৃক্ষের মতো অনড় নই
তুমি যতবার ফিরে এসেছ ততবারই ভেবেছ
আমি কদমবৃক্ষ হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকব
কিন্তু এখন দেখ আমি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকলেও
হয়ে গিয়েছি বৃক্ষের অধিক এক কম্পমান সত্তা
বাঁশি বাজিয়ে ফুঁ ধরেছি আর চতুর্দিক থেকে কেঁদে
উঠেছে রাধারা
আমি কি বলেছিলাম ঘর ভেঙে আমার কাছে এসো
আমি কি বলেছিলাম যমুনায় কলস ভাসিয়ে
         সিক্ত অঙ্গে কদমতলায় মিলিত হও ?
আমি তো বলিনি লাজ লজ্জা সংসার সম্পর্ক যমুনার জলে
                                 ভাসিয়ে দাও
আমি তো নদীর স্বভাব জানি স্রোত বুঝি কূল ভাঙা বুঝি
কিন্তু তোমাকে বুঝতে বাঁশিতে দেখ কতগুলো ছিদ্র
সব ছিদ্র থেকেই ফুঁ বেরোয়
আর আমার বুক থেকে রক্ত।

>…

    আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে
    হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।
    নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে ?
    -হাত দিওনা আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।
    বললো কেঁদে তিতাস নদী হরিণবেড়ের বাঁকে
    শাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছড়িয়ে থাকে।

    জল ছাড়িয়ে দল হারিয়ে গেলাম বনের দিক
    সবুজ বনের হরিৎ টিয়ে করে রে ঝিকমিক।
    বনের কাছে এই মিনতি, ফিরিয়ে দেবে ভাই,
    আমার মায়ের গয়না নিয়ে ঘরকে যেতে চাই।

    কোথায় পাবো তোমার মায়ের হারিয়ে যাওয়া ধন
    আমরা তো সব পাখপাখালি বনের সাধারণ।
    সবুজ চুলে ফুল পিন্দেছি নোলক পরি নাতো !
    ফুলের গন্ধ চাও যদি নাও, হাত পাতো হাত পাতো
    বলে পাহাড় দেখায় তাহার আহার ভরা বুক
    হাজার হরিণ পাতার ফাঁকে বাঁকিয়ে রাখে মুখ।
    এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন, ফের বাড়ালাম পা
    আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরকে যাবো না।

>…

    আম্মা বলেন, পড়রে সোনা
               আব্বা বলেন, মন দে;
    পাঠে আমার মন বসে না
               কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।

    আমার কেবল ইচ্ছে জাগে
               নদীর কাছে থাকতে,
    বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে
               পাখির মতো ডাকতে।

    সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
               কর্ণফুলীর কূলটায়,
    দুধভরা ঐ চাঁদের বাটি
               ফেরেস্তারা উল্টায়।

    তখন কেবল ভাবতে থাকি
               কেমন করে উড়বো,
    কেমন করে শহর ছেড়ে
               সবুজ গাঁয়ে ঘুরবো !

    তোমরা যখন শিখছো পড়া
               মানুষ হওয়ার জন্য,
    আমি না হয় পাখিই হবো,
               পাখির মতো বন্য।
..

>…

    ট্রাক ! ট্রাক ! ট্রাক !
    শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে
    দুয়োর বেঁধে রাখ।

    কেন বাঁধবো দোর জানালা
    তুলবো কেন খিল ?
    আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে
    ফিরবে সে মিছিল।

    ট্রাক ! ট্রাক ! ট্রাক !
    ট্রাকের মুখে আগুন দিতে
    মতিয়ুরকে ডাক।

    কোথায় পাবো মতিয়ুরকে
    ঘুমিয়ে আছে সে !
    তোরাই তবে সোনামানিক
    আগুন জ্বেলে দে।

>…

    ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
           দুপুর বেলার অক্ত
    বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায় ?
           বরকতের রক্ত।

    হাজার যুগের সূর্যতাপে
           জ্বলবে এমন লাল যে,
    সেই লোহিতেই লাল হয়েছে
           কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে !

    প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে
           ছড়াও ফুলের বন্যা
    বিষাদগীতি গাইছে পথে
           তিতুমীরের কন্যা।

    চিনতে না কি সোনার ছেলে
           ক্ষুদিরামকে চিনতে ?
    রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে
           মুক্ত বাতাস কিনতে ?

    পাহাড়তলীর মরণ চূড়ায়
           ঝাঁপ দিল যে অগ্নি,
    ফেব্রুয়ারির শোকের বসন
           পরলো তারই ভগ্নী।

    প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী
           আমায় নেবে সঙ্গে,
    বাংলা আমার বচন, আমি
           জন্মেছি এই বঙ্গে।
..

>…

    একটু ছিল বয়েস যখন ছোট্ট ছিলাম আমি
    আমার কাছে খেলাই ছিল কাজের চেয়ে দামি।
    উঠোন জুড়ে ফুল ফুটেছে আকাশ ভরা তারা
    তারার দেশে উড়তো আমার পরাণ আত্মহারা।
    জোছনা রাতে বুড়িগঙ্গা তুলতো যখন ঢেউ
    আমার পিঠে পরীর ডানা পরিয়ে দিতো কেউ।
    দেহ থাকতো এই শহরে উড়াল দিতো মন
    মেঘের ছিটার ঝিলিক পেয়ে হাসতো দু’নয়ন।
    তারায় তারায় হাঁটতো আমার ব্যাকুল দু’টি পা
    নীল চাঁদোয়ার দেশে হঠাৎ রাত ফুরাতো না।
    খেলার সাথী ছিল তখন প্রজাপতির ঝাঁক
    বনভাদালির গন্ধে কত কুটকুটোতো নাক;
    কেওড়া ফুলের ঝোল খেয়ে যে কোল ছেড়েছে মা’র
    তার কি থাকে ঘরবাড়ি না তার থাকে সংসার ?

    তারপরে যে কী হলো, এক দৈত্য এসে কবে
    পাখনা দুটো ভেঙে বলে মানুষ হতে হবে।
    মানুষ হওয়ার জন্য কত পার হয়েছি সিঁড়ি
    গাধার মত বই গিলেছি স্বাদ যে কি বিচ্ছিরি।
    জ্ঞানের গেলাস পান করে আজ চুল হয়েছে শণ
    কেশের বাহার বিরল হয়ে উজাড় হলো বন।
    মানুষ মানুষ করে যারা মানুষ তারা কে ?
    অফিস বাড়ির মধ্যে রোবোট কলম ধরেছে।
    নরম গদি কোশন আসন চশমা পরা চোখ
    লোক ঠকানো হিসেব লেখে, কম্প্যুটারে শ্লোক।
    বাংলাদেশের কপাল পোড়ে ঘূর্ণিঝড়ে চর
    মানুষ গড়ার শাসন দেখে বুক কাঁপে থরথর।
    ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’- গান শোননি ভাই ?
    মানুষ হবার ইচ্ছে আমার এক্কেবারে নাই।

>…

অঙ্ক নিয়ে বসলে আমার কখন কী যে হয়
টেবিলটাও পর হয়ে যায় বইগুলো সব ভয়।
ভয়ের চোটে ভাবতে থাকি শহর ভেঙে কেউ
দালান কোঠা বিছিয়ে দিয়ে তোলে খেতের ঢেউ।
রাস্তাগুলো নদী এবং গলিরা সব খাল
ইলেকট্রিকের খাম্বাগুলো পাল্টে হলো তাল।
মোটরগাড়ি গরুর পালে হাম্বা তুলে হাঁটে
পুলিশগুলো গুলিস্তানে নিড়ানি ঘাস কাটে।
আব্বা হলেন কাকতাড়ুয়া আম্মা হলুদ পাখি
বুবুরা সব ভুঁইকুমড়ো পাতায় ঢেকে রাখি।

সবাই যখন পাল্টে গেছে নিজের ঘরে নাই
আমিই তখন ইচ্ছে মতন খোকন হয়ে যাই।
কেউ বলে না আঁক কষতে কেউ বলে না লেখ্
কেউ ধরে না কানের লতি, কেউ বলে না শেখ্।
ঢাকা শহর, ঢাকা শহর সবুজ হয়ে যাও
কলেজগুলো সর্ষে বাগান ভার্সিটিতে লাউ।

>…
আমার ঘরের পাশে ফেটেছে কি কার্পাশের ফল?
গলায় গুঞ্জার মালা পরো বালা, প্রাণের শবরী,
কোথায় রেখেছো বলো মহুয়ার মাটির বোতল
নিয়ে এসো চন্দ্রালোকে তৃপ্ত হয়ে আচমন করি।
ব্যাধির আদিম সাজে কে বলে যে তোমাকে চিনবো না
নিষাদ কি কোনদিন পক্ষিণীর গোত্র ভুল করে?
প্রকৃতির ছদ্মবেশে যে-মন্ত্রেই খুলে দেন খনা
একই জাদু আছে জেনো কবিদের আত্মার ভিতরে।
নিসর্গের গ্রন্থ থেকে, আশৈশব শিখেছি এ-পড়া
প্রেমকেও ভেদ করে সর্বভেদী সবুজের মূল,
চিরস্থায়ী লোকালয় কোনো যুগে হয়নি তো গড়া
পারেনি ঈজিপ্ট, গ্রীস, সেরাসিন শিল্পীর আঙুল।
কালের রেঁদার টানে সর্বশিল্প করে থর থর
কষ্টকর তার চেয়ে নয় মেয়ে কবির অধর।

>…

সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়না হরিণী
যদি নাও দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি,
আত্মবিক্রয়ের স্বর্ন কোনোকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;
ভালবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্বন,
ছলনা জানিনা বলে আর কোনো ব্যাবসা শিখিনি
দেহ দিলে দেহ পাবে দেহের অধিক মূলধন
আমারতো নেই শখি, যেই পণ্যে অলংকার কিনি।
বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরষ আবৃত করে জলপাই পাতাও থাকবেনা,
তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরষ্পর হব চিরচেনা
পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয়না কবিরা;
দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা- উপশিরা।

এ -তীর্থে আসবে যদি ধীরে অতি পা ফেল সুন্দরী,
মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ মাটির গায়।
ছিন্ন তালপত্র ধরে এসো সেই গ্রন্থ পাঠ করি
কত অশ্রু লেগে আছে এই জীর্ণ তালের পাতায়।
কবির কামনা হয়ে আসবেকি হে বন্য বালিকা
অভাবের াজগর জেনো তবে আমার টোটেম,
সতেজ খুনের মত এঁকে দেব হিঙুলের টিকা।

>…

অনিচ্ছায কতকাল মেলে রাখি দৃশ্যপাযী তৃষ্ণার লোচন
ক্লান্ত হযে আসে সব, নিসর্গও ঝরে যায বহুদূর অতল আঁধারে
আর কী থাকলো তবে হে নীলিমা, হে অবগুণ্ঠন
আমার কাফন আমি চাদরের মতো পরে কতদিন আন্দোলিত হবো
কতকাল কতযুগ ধরে
দেখবো, দেখার ভারে বৃষের স্কন্ধের মতো নুযে আসে রাত্রির আকাশ?
কে ধারালো বর্শা হেনে অসংখ্য ক্ষতের সৃষ্টি করে সেই কৃষ্ণকায
ষাঁডের শরীরে
আর সে আঘাত থেকে কী-যে ঝরে পডে ঠিক এখনো বুঝি না
একি রক্ত, মেদ, অগ্নি কিম্বা শ্বেত আলো ঝরে যায
অবিরাম অহোরাত্র প্রাণ আর কিমাকার ভূগোলে কেবলই–
ঝরে যায ঝরে যেতে থাকে।

ক্রমে তাও শেষ হলে সে বন্য বৃষভ যেন গলে যায় নিসর্গশোভায।
তুমি কি সোনার কুম্ভ ঠেলে দিযে দৃশ্যের আডালে দাঁডাও
হে নীলিমা, হে অবগুণ্ঠন?
আকাশে উবুড হযে ভেসে যেতে থাকে এক আলোর কলস
অথচ দেখে না কেউ, ভাবে না কনককুম্ভ পান করে কালের জঠর;
ভাবে না, কারণ তারা প্রতিটি প্রভাতে দেখে ভেসে ওঠে আরেক আধার
ছলকায, ভেসে যায, অবিশ্রাম ভেসে যেতে থাকে।

কেমন নিবদ্ধ হযে থাকে তারা মৃত্তিকা, সন্তান আর শস্যের ওপরে
পুরুষের কটিবন্ধ ধরে থাকে কত কোটি ভযার্ত যুবতী
ঢাউস উদরে তারা কেবলই কি পেতে চায অনির্বাণ জন্মের আঘাত।
মাংসের খোডল থেকে একে একে উডে আসে আত্মার চডুই
সমস্ত ভূগোল দ্যাখো কী বিপন্ন শব্দে ভরে যায
ভরে যায, পূর্ণ হতে থাকে।

এ বিষণ্ণ বর্ণনায আমি কি অন্তত একটি পংক্তিও হবো না
হে নীলিমা, হে অবগুণ্ঠন?
লোকালয থেকে দূরে, ধোঁযা অগ্নি মশলার গন্ধ থেকে দূরে
এই দলকলসের ঝোপে আমার কাফন পরে আমি কতকাল
কাত হযে শুযে থেকে দেখে যাবো সোনার কলস আর বৃষের বিবাদ?