Archive for the ‘তসলিমা নাসরিন (১৯৬২ – )’ Category

>…

ভুল প্রেমে কেটে গেছে তিরিশ বসন্ত, তবু
এখনো কেমন যেন হৃদয় টাটায়-
প্রতারক পুরুষেরা এখনো আঙুল ছুঁলে
পাথর শরীর বয়ে ঝরনার জল ঝরে।

এখনো কেমন যেন কল কল শব্দ শুনি
নির্জন বৈশাখে, মাঘ-চৈত্রে-
ভুল প্রেমে কেটে গেছে তিরিশ বসন্ত, তবু
বিশ্বাসের রোদে পুড়ে নিজেকে অঙ্গার করি।

প্রতারক পুরুষেরা একবার ডাকলেই
ভুলে যাই পেছনের সজল ভৈরবী
ভুলে যাই মেঘলা আকাশ, না-ফুরানো দীর্ঘ রাত।
একবার ডাকলেই
সব ভুলে পা বাড়াই নতুন ভুলের দিকে
একবার ভালোবাসলেই
সব ভুলে কেঁদে উঠি অমল বালিকা।

ভুল প্রেমে তিরিশ বছর গেল
সহস্র বছর যাবে আরো,
তবু বোধ হবে না নির্বোধ বালিকার।

>…

এতকাল চেনা এই আমার শরীর
সময় সময় একে আমি নিজেই চিনি না।
একটি কর্কশ হাত
নানান কৌশল করে চন্দন চর্চ্চিত হাতখানি ছুঁলে
আমার স্নায়ুর ঘরে ঘণ্টি বাজে, ঘণ্টি বাজে

এ আমার নিজের শরীর
শরীরের ভাষা আমি পড়তে পারি না।
সে নিজেই তার কথা বলে নিজের ভাষায়।
তখন আঙুল, চোখ, ঠোঁট, এই মসৃণ পা
কেউই আমার নয়।
এ আমারই নয়
এ আমারই হাত।
অথচ এ হাত আমি সঠিক চিনি না
এই আমারই ঠোঁট, এ আমার জংঘা-উরু
এসবের কোন পেশী, কোন রোমকূপ
আমার অধীন নয়, নিয়ন্ত্রিত নয়।

স্নায়ুর দোতলা ঘরে ঘণ্টি বাজে
এই পৃথিবীতে আমি তবে কার ক্রীড়নক
পুরুষ না প্রকৃতির ?

আসলে পুরুষ নয়
প্রকৃতিই আমাকে বাজায়
আমি তার শখের সেতার।

পুরুষের স্পর্শে আমি
ঘুমন্ত শৈশব ভেঙে জেগে উঠি
আমার সমুদ্রে শুরু হয় হঠাৎ জোয়ার।
রক্তে মাংসে ভালবাসার সুগন্ধ পেলে
প্রকৃতিই আমাকে বাজায়
আমি তার শখের সেতার।

>

ইসরাফিলের জ্বর হয়েছে, জিবরাইলের কাশি
মুনকার আর নাকির গেছে হুরের নিমন্ত্রণে
আল্লাহতায়ালা তালি দিচ্ছেন, ফেরেশতারা নেই

শিঙায় আবার জং ধরেছে, জং সারাবার
মিস্ত্রি এসে নাটবল্টু খুলে
উপুড় করে ঢেলে দিচ্ছে সয়াবিনের ড্রাম
জাহান্নামের সাপ ওদিকে খিদের চোটে ঘুম।

আল্লাহতায়ালা হাঁক দিচ্ছেন ফেরেশতারা নেই
ফেরেশতারা যে যার মতো সাত আকাশে ঘোরে
ইসরাফিলের জ্বর হয়েছে শিঙা ফুঁকবে কে?
শিঙা ফুঁকতে দাঁড়িয়ে গেছে মানুষ এবং জ্বিন
পুলসেরাতে একলা বসে শেষ বিচারক কাঁদেন
আর, আখিরাতের দাঁড়িপাল্লা কবজা খসে পড়ে।

>…

সত্য বললে কিছু লোক আছে খুব রাগ করে,
এখন থেকে আর সত্য বোলো না তসলিমা।
গ্যালিলিওর যুগ নয় এই যুগ, কিন্তু
এই একবিংশ শতাব্দীতেও
সত্য বললে একঘরে করে রাখে সমাজ,
দেশছাড়া করে দেশ।
গৃহবন্দী করে রাষ্ট্র,
রাষ্ট্র শাস্তি দেয়,
সত্য বোলো না।

তার চেয়ে মিথ্যে বলো,
বলো যে পৃথিবীর চারদিকে সূর্য ঘোরে,
বলো যে সূর্যের যেমন নিজের আলো আছে, চাঁদেরও আছে,
বলো যে পাহাড়গুলো পৃথিবীর গায়ে পেরেকের মতো পুঁতে দেওয়া,
বলো যে পুরুষের পাঁজরের হাড় থেকে নারীকে বানানো,
বলো যে নারীর ঘাড়ের কী যেন একটা খুব বাকা।
বলো যে শেষ-বিচারের দিনে মানুষেরা সব কবর থেকে,
ছাই থেকে, নষ্ট হাড়গোড় থেকে টাটকা যুবক যুবতী হয়ে
আচমকা জেগে উঠবে, স্বর্গ বা নরকে অনন্তকালের জন্য জীবন কাটাতে যাবে।
তুমি মিথ্যে বলো তসলিমা।
বলো যে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের অগুণতি গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্ররাজি মিথ্যে,
মাধ্যাকর্ষণ শক্তি মিথ্যে, মানুষ চাঁদে গিয়েছিল, মিথ্যে।

মিথ্যে বললে তুমি নির্বাসন থেকে মুক্তি পাবে,
তুমি দেশ পাবে, প্রচুর বন্ধু পাবে,
হাত পায়ের শেকল খুলে দেওয়া হবে, তুমি আলো দেখবে, আকাশ দেখবে।
একা একা অন্ধকারে হাঁমুখো মৃত্যুর মুখে ছুড়ে দেবে না তোমাকে কেউ।
তুমি সত্য বলো না তসলিমা,
বাঁচো।

২৫ জানুয়ারী ২০০৮

>

আবার আমি তোমার হাতে রাখবো বলে হাত
গুছিয়ে নিয়ে জীবনখানি উজান ডিঙি বেয়ে
এসেছি সেই উঠোনটিতে গভীর করে রাত
দেখছ না কি চাঁদের নীচে দাঁড়িয়ে কাঁদি দুঃখবতী মেয়ে !

আঙুলগুলো কাঁপছে দেখ, হাত বাড়াবে কখন ?
কুয়াশা ভিজে শরীরখানা পাথর হয়ে গেলে ?
হাত ছাড়িয়ে নিয়েছিলাম বর্ষা ছিল তখন,
তখন তুমি ছিঁড়ে খেতে আস্ত কোনও নারী নাগাল পেলে।

শীতের ভারে ন্যুব্জ বাহু স্পর্শ করে দেখি
ভালবাসার মন মরেছে, শরীর জবুথবু,
যেদিকে যাই, সেদিকে এত ভীষণ লাগে মেকি।
এখনও তুমি তেমন আছ। বয়স গেল, বছর গেল, তবু।

নিজের কাঁধে নিজের হাত নিজেই রেখে বলি :
এসেছিলাম পাশের বাড়ি, এবার তবে চলি।


>

ঘুম ভাঙার আগেই চাই suprovat
না হলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে থাকি, হাত
গুটিয়ে পা গুটিয়ে, বেড়াল কুণ্ডুলি,
সূর্যকিরণ আলতো করে স্নায়ুতন্ত্রে ঢুকিয়ে দেয় ঠাকুরমার ঝুলি।

সকাল জুড়ে ki karcho? Ki hacche? Kamon accho?র জ্বালা
তার ঘূর্ণিঝড়ে ওড়াতে থাকে মনের চৌচালা।
– tomake khub jalacchi ki?
– se ki!
– satti kore bolte paro, jalacchi na, tomake?
– jalacchen, khub jalacchen এক পলকে লিখে দিই লেখালেখির ফাঁকে।
– Thik acche ar jalabo na.
– konodin na?
– konodin na.
– satti satti tin satti
– Jodi ami jolte bhalobasi tobuo na?
– tobuo na.
ওপাশে এক তবুও না-র ভূতূড়ে নিঃশ্বাস
মুঠোফোনের ভেতর হঠাৎ নৈঃশব্দের বাজনা বাজে, বাজে সর্বনাশ!
– dhut!
এদিকে দেখি সন্ধে হলেই লাল ধুতিতে সেজেগুজে সামনে দেবদূত
চমক দিয়ে উদয় হলেন, চক্ষে হাসি, তিনি,
যাকে হাজার বছর চিনি।
সঙ্গে নিয়ে গঙ্গার পাড়, মৃদুমন্দ হাওয়া খাওয়া, এট্টুআট্টু নাচানাচির
পাট চুকোলে
বাড়ি ফেরার পথে আমার মাতাল যাদুকর, মাথাটিকে নিজের কোলে
নিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে বলে দিলেন, তোমাকে খুব ভালবাসি।
তখন কেবল চক্ষে নয়, সর্বাঙ্গে হাসি।

এস এম এস মধ্যরাতে, হাতেনাতে ধরি বুকের বিষম ধুকপুক,
মুচড়ে দিয়ে হৃৎপিন্ড হুড়মুড়িয়ে নামে তীব্র সুখ।
– Jatakkhan jege thaki tomar katha bhabi, jatakkhan
ghumoi ami, tomay swapno dekhi.
– se ki! esob kotha satti naki meki?
– satti satti tin satti
– huh! biswas nei ak rotti.
বলি কিন্তু সারারাতই না ঘুমিয়ে কাটাই,
সারারাতই গোত্তা খেয়ে ঘুড়ির মতো তার দিকে ধাই, যার হাতে
লাটাই।
পরের দিন ভর দুপুরে উন্মাদিনী দৌড়ে যাই,
দেখে হাসেন বাবুমশাই।
হৃদয় যখন গলে পড়ছে, শরীর জুড়ে প্রেমের অনুভব,
তিনি তুমুল হেসে বলেন, কালকে রাতে ঢপ মেরেছি, ঢপ।

– Dhop mane ki?
– eeh, bojhona bujhi?

কৃতজ্ঞতা : তমসো দীপ

>…

মানুষের চরিত্রই এমন
বসলে বলবে না, বসো না
দাঁড়ালে, কি ব্যাপার হাঁটো
আর হাঁটলে, ছি: বসো।
শুয়ে পড়লে ও তাড়া – নাও উঠো,
না শুলেও স্বষ্তি নেই, একটু তো শোবে !
ওঠ বস করে করে নষ্ট হচ্ছে দিন
এখনো মরতে গেলে বলে ওঠে – বাঁচো
না জানি কখন ও বাঁচতে দেখলে বলে উঠবে – ছি: মরো!
বড় ভয়ে গোপনে গোপনে বাঁচি।

>…

তুমি মেয়ে,
তুমি খুব ভাল করে মনে রেখো
তুমি যখন ঘরের চৌকাঠ ডিঙোবে
লোকে তোমাকে আড়চোখে দেখবে।
তুমি যখন গলি ধরে হাঁটতে থাকবে
লোকে তোমার পিছু নেবে, শিস দেবে।
তুমি যখন গলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠবে
লোকে তোমাকে চরিত্রহীন বলে গাল দেবে।

যদি তুমি অপদার্থ হও
তুমি পিছু ফিরবে
আর তা না হলে
যেভাবে যাচ্ছ, যাবে।

ফেব্রুয়ারী ১৯৯০।