Archive for the ‘শহীদ কাদরী (১৯৪২ – )’ Category

>…

‘The worlds owes me a million dollars’
-Gregory Corso

টাকাগুলো কবে পাবো? সামনের শীতে?
আসন্ন গ্রীস্মে নয়?
তবে আর কবে! বৈশাখের ঝড়ের মতো
বিরূপ বাতাসে ঝরে পড়ছে অঝোরে
মণি মাণিক্যের মতো মূল্যবান চুলগুলো আমার এদিকে-
ওদিকে! এখনই মনি-অর্ডার না যদি পাঠাও হে সময়,
হে কাল, হে শিল্প,
তবে
কবে? আর কবে?
যখন পড়বে দাঁত, নড়বে দেহের ভিৎ ?

দ্যাখো দ্যাখো, মেঘের তালি-মারা নীল শার্ট প’রে
ফ্রিজিডেয়ার অথবা কোনো রেকর্ড প্লেয়ার ছাড়া
খামোকা হুল্লোড় করতে করতে যারা পৌঁছে যায়
দারুণ কার্পেটহীনভাবে কবিতার সোনালি তোরণে
সেই সব হা-ঘরে, উপোসী ও উল্লুকদের ভীড়ে
মিশে গিয়ে
আমিও হাসছি খুব বিশ্ববিজয়ীর মতো মুখ করে।
আমাকে দেখলে মনে হবে-
গোপন আয়ের ব্যবস্থা ঠিকই আছে।
-আছেই তো। অস্বীকার কখনো করেছি আমি
হে কাল, হে শিল্প?
ওরা জানে না এবং কোনোদিন জানবে না-

পার্কের নি:সঙ্গ বেঞ্চ,
রাতের টেবিল আর রজনীগন্ধার মতো কিছু শুভ্র সিগারেট ছাড়া
কেউ কোনোদিন জানবে না- ব্যক্তিগত ব্যাঙ্ক এক
আমারও রয়েছে! ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামক বিশাল
বাণিজ্যালয়ের সাথে যোগাযোগ আমিও রেখেছি।

তাছাড়া জীবনান্দ দাশ এবং সুধীন্দ্রনাথসহ
ওসামু দাজাই
আমাকে টাকা পয়সা নিয়মিতভাবে এখনও পাঠান
বলতে পারো এ ব্যবসা বিশ্বব্যাপী-
একবার শার্ল বোদলেয়ার প্রেরিত এক পিপে সুরা আমি
পেয়েছিলাম কৈশরে পা রেখে,
রিল্কে পাঠিয়েছিলেন কিছু শিল্পিত গোলাপ
(একজন প্রেমিকের কাছে আমি বিক্রি করেছি নির্ভয়ে)
এজরা পাউন্ড দিয়েছিলেন অনেক ডলার
রাশি রাশি থলে ভরা অসংখ্য ডলার
(ডলার দিয়ে কিনেছি রাতের আকাশ)
এবং একটি গ্রীক মুদ্রা
(সে গ্রীক মুদ্রাটি সেই রাতের আকাশে নিয়মিত জ্বলজ্বল করে)

অতএব কপর্দক-শূন্য আমি,কোনো পুণ্য নেই
আমার বিব্রত অস্তিত্বের কাছে
কেউ নয় ঋণী- এমন দারুণ কথা
কি করে যে বলি! যেদিকে তাকাই
পার্কে, পেভমেন্টে, আঁধারে, রাস্তায়
রেস্তোরায়ঁ, ছড়ানো ছিটানো
প্রজ্জ্বোল কবিতাগুলো চতুর্দিক থেকে উঠে এসে
দুটো নিরপরাধ নরম বই হয়ে ইতিমধ্যে
তোমাদের নোংরা অঙ্গুলির নীচে চলে গেলো,
এই কি যথেষ্ট নয়? এতেই কি লক্ষ লক্ষ টাকা
লেখা হলো না আমার নামে, পাওনা হলো না?
হে সময়, হে কাল, হে শিল্প. হে বান্ধববৃন্দ,
টাকাগুলো কবে পাবো, কবে, কবে, কবে?

>

আমি তোমাদেররই দিকে যেতে চাই
ঝকঝকে নতুন একটি সেতু
যেমন নদীর পাড়ে দাঁড়ানো ঐ লোকগুলোর কাছে পৌছে যেতে চায়
কিন্তু তামা ও পিতলসহ বাসন-কোসন,চিড়ে-গুড় ইত্যাদি গোছাতে
তোমরা ব্যস্ত,বড্ড ব্যস্ত।

মাঝে মাঝে দূর থেকে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে তোমাদের ব্যস্ততা দেখতে
ভালবাসি।

সমুদ্র তরঙ্গগুলো সমুদ্রকে নিয়ে এ্যাতো ব্যস্ত নয়,
অরণ্যের অভ্যন্তরে ক্ষুধার্ত,স্বাধীন বাঘ হরিণের জন্য এ্যাতো
ব্যস্ত নয়,
দীর্ঘ অপেক্ষার পর প্রেমিকের হাত ব্রেসিয়ারের ভেতর এ্যাতো
ব্যস্ত নয়,

আমি তোমাদেররই দিকে যেতে চাই
শীতের পর প্রথম উল্টাপাল্টা বাতাস যেমন
প্রত্যেকটি ফাঁক-ফোকর এবং রন্ধ্র দিয়ে যেতে চায় তোমাদের
চোখে-মুখে-চুলে
কিন্তু তৈজসপত্র রঙ,টেবিল চেয়ারের ঢঙ,জানালার পর্দা
ইত্যাদি
বদলাতে,গোছগাছ করতে
তোমরা ব্যস্ত,বড্ড বেশি ব্যস্ত।

ক্বচিৎ-কখনো খুব কাছ থেকে তোমাদের প্রচন্ড ব্যস্ততা আমি দেখি,
দিগন্ত আঁধার-করা সজল শ্রাবণও বৃষ্টি ঝরানোর জন্য
অমন ব্যস্ত নয়,
তাক-করা রাইফেলের অমোঘ রেন্জ থেকে উড়ে পালানোর জন্য
হরিয়ালের ঝাঁকও অমন ব্যস্ত নয়,
কর্কট-রোগীর দেহে ক্যান্সারের কোষগুলো ছড়িয়ে পড়ার জন্য
অমন ব্যস্ত নয়,

আমি তো তোমাদেরই দিকে যেতে চাই
ইন্দ্রনীল একটি মোহন আংটি
প্রেমিকের কম্পমান হাত থেকে প্রেমিকার আঙ্গুলে যেমন
উঠে যেতে চায়,
কিন্তু চাষাবাদ,বানিজ্য এবং প্রতিযোগিতামূলক শিল্প
ইত্যাদি বিষয় নিয়ে
তোমরা ব্যস্ত,বড্ড বেশি ব্যস্ত।

হরিণ-হননকারী ব্যাধের মাংসল মুঠো থেকে ছুটে-যাওয়া
বল্লমের মতো তোমরা ব্যস্ত
দিগভ্রান্ত তৃষ্ণার্ত পথিককে গিলে ফেলার জন্য উত্তর বাংলার
চোরাবালির মতো তোমরা ব্যস্ত
চিরচেনা বৃক্ষরাজিকে পল্লবশূন্য করার জন্য শীতের জটিল
বিস্তারের মতো তোমরা ব্যস্ত
যাত্রী নিয়ে ঘর-ফেরা নৌকাগুলো হরণ করার জন্য চোরাস্রোত
এবং ঘূর্ণিপাকের মতো তোমরা ব্যস্ত

তোমরা ব্যস্ত,তোমরা ব্যস্ত,তোমরা ব্যস্ত
তোমারা বড্ড বেশি ব্যস্ত
অথচ আমি তো আজীবন তোমাদেরই দিকে যেতে চাই।
কেন যেতে চাই!

>

We must love one another or die- W.H Auden

না,প্রেম সে কোনো ছিপছিপে নৌকা নয়-
যার চোখ,মুখ,নাক ঠুকরে খাবে
তলোয়ার- মাছের দঙ্গল,সুগভীর জলের জঙ্গলে
সমুদ্রচারীর বাঁকা দাঁতের জন্যে যে উঠেছে বেড়ে,
তাকে,হ্যাঁ,তাকে কেবল জিজ্ঞেস ক’রো,সেই বলবে
না,প্রেম সে কোনো ছিপছিপে নৌকা নয়,
ভেঙে-আসা জাহাজের পাটাতন নয়,দারুচিনি দ্বীপ নয়,
দীপ্র বাহুর সাঁতার নয়; খড়খুটো? তা-ও নয়।
ঝোড়ো রাতে পুরোনো আটাচালার কিংবা প্রবল বৃষ্টিতে
কোনো এক গাড়ি বারান্দার ছাঁট-লাগা আশ্রয়টুকুও নয়,
ফুসফুসের ভেতর যদি পোকা-মাকড় গুন্জন ক’রে ওঠে
না,প্রেম তখন আর শুশ্রূষাও নয়; সর্বদা,সর্বত্র
পরাস্ত সে; মৃত প্রেমিকের ঠান্ডা হাত ধ’রে
সে বড়ো বিহ্বল,হাঁটু ভেঙে- পড়া কাতর মানুষ।
মাথার খুলির মধ্যে যখন গভীর গূঢ় বেদনার
চোরাস্রোত হীরকের ধারালো- ছটার মতো
ব’য়ে যায়,বড়ো তাৎপর্যহীন হ’য়ে ওঠে আমাদের
ঊরুর উত্থান,উদ্যত শিশ্নের লাফ,স্তনের গঠন।

মাঝে মাঝে মনে হয় শীতরাতে শুধু কম্বলের জন্যে,
দুটো চাপাতি এবং সামান্য শব্জীর জন্যে
কিংবা একটু শান্তির আকাঙ্খায়,কেবল স্বস্তির জন্যে
বেদনার অবসান চেয়ে তোমাকে হয়তো কিছু বর্বরের কাছে
অনায়াসে বিক্রি ক’রে দিতে পারি-অবশ্যই পারি।
কিন্তু এখন,এই মুহূর্ত, এই স্বীকারোক্তির পর মনে হলো:
হয়তো বা আমি তা পারি না-হয়তো আমি তা পারবো না।

>
বাতাস আমাকে লম্বা হাত বাড়িয়ে
চুলের ঝুঁটি ধরে ঘুরে বেড়িয়েছে আজ সারাদিন
কয়েকটা লতাপাতা নিয়ে
বিদঘুটে বাতাস,
হাতকড়া পরিয়ে দিয়েছে আমাকে,
লাল পাগড়ি-পরা পুলিশের মত কৃষ্ণচূড়া
হেঁকে বললো :
‘তুমি বন্দী’ !

আজ সকাল থেকে একজোড়া শালিক
গোয়েন্দার মতো ঘুরছে
যেন এভিনিউ পার হ’য়ে নির্জন সড়কে
পা রাখলেই আমাকে গ্রেপ্তার ক’রে নিয়ে যাবে ঠিক !

‘তুমি অপরাধী’
-এই কথা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে যেন
ব’লে গেল বজ্রসহ এক পশলা হঠাৎ বৃষ্টিপাত-
‘তুমি অপরাধী’-
মানুষের মুখের আদলে গড়া একটি গোলাপের কাছে।’

বৃষ্টিভেজা একটি কালো কাক
একটি কম্পমান আধ-ভাঙা ডালের ওপর থেকে
কিছুটা কাতর আর কিছুটা কর্কশ গলায়
আবার ব’লে উঠলো: তুমি অপরাধী!

আজ সারাদিন বাতাস,বৃষ্টি আর শালিক
আমাকে ধাওয়া করে বেড়ালো
এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত
তোমার বাড়ির
কিন্নরকন্ঠ নদী অবধি আমি গেলাম
কিন্তু সেখানে ঘাটের উপর একটি প্রাচীন বুড়ি
সোনার ছাই দিয়ে ঘটি-বাটি মেজে চলেছে আপন মনে।
একটা সাংঘাতিক সূক্ষ ধ্বনি শুয়ে আছে
পিরিচে,পেয়ালায়।

ঐ বাজনা শুনতে নেই
ঐ বাজনা নৌকার পাল খুলে নেয়
ঐ বাজনা ষ্টীমারকে ডাঙার ওপর আছড়ে ফ্যালে
ঐ বাজনা গ্রাস করে প্রেম,স্মৃতি,শস্য,শয্যা,ও গৃহ

তোমার বাড়ির
কিন্নরকন্ঠ নদী অবধি আমি গিয়েছিলাম।
কিন্তু হাতভর্তি শালিকের পালক
আর চুলের মধ্যে এলোপাথারি বৃষ্টির ছাঁট নিয়ে
উল্টোপাল্টা পা ফেলে
তোমার দরজা পর্যন্ত যেতে ইচ্ছে হল না।

ঐ শালিকের ভেতর উনুনের আভা,মশলার ঘ্রাণ।
তোমার চিবুক,রুটি আর লালচে চুলের গন্ধ,
ঐ বৃষ্টির ফোঁটার মধ্যে পাতা আছে তোমার
বারান্দার চেয়ারগুলো
তাহলে তোমার কাছে গিয়ে আর কি হবে!

আজ একজোড়া শালিক
গোয়েন্দা পুলিশের মতো
বাতাস একটা বুনো একরোখা মোষের মতো
আমাকে ধাওয়া করে বেড়ালো এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত

আমি অনেকদিন পর একজন হা-ঘরে
উদ্বাস্তু হ’য়ে চরকির মতো গোটা শহর ঘুরে বেড়ালাম।

>
ভয় নেই
আমি এমন ব্যবস্থা করবো যাতে সেনাবাহিনী
গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে
মার্চপাস্ট করে চলে যাবে
এবং স্যালুট করবে
কেবল তোমাকে প্রিয়তমা।

ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
বন-বাদাড় ডিঙ্গিয়ে
কাঁটা-তার, ব্যারিকেড পার হয়ে, অনেক রণাঙ্গনের স্মৃতি নিয়ে
আর্মার্ড-কারগুলো এসে দাঁড়াবে
ভায়োলিন বোঝাই করে
কেবল তোমার দোরগোড়ায় প্রিয়তমা।

ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো-
বি-৫২ আর মিগ-২১গুলো
মাথার ওপর গোঁ-গোঁ করবে
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
চকোলেট, টফি আর লজেন্সগুলো
প্যারাট্রুপারদের মতো ঝরে পড়বে
কেবল তোমার উঠোনে প্রিয়তমা।

ভয় নেই…আমি এমন ব্যবস্থা করবো
একজন কবি কমান্ড করবেন বঙ্গোপসাগরের সবগুলো রণতরী
এবং আসন্ন নির্বাচনে সমরমন্ত্রীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায়
সবগুলো গণভোট পাবেন একজন প্রেমিক, প্রিয়তমা!

সংঘর্ষের সব সম্ভাবনা, ঠিক জেনো, শেষ হবে যাবে-
আমি এমন ব্যবস্থা করবো, একজন গায়ক
অনায়াসে বিরোধীদলের অধিনায়ক হয়ে যাবেন
সীমান্তের ট্রেঞ্চগুলোয় পাহারা দেবে সারাটা বৎসর
লাল নীল সোনালি মাছি-
ভালোবাসার চোরাচালান ছাড়া সবকিছু নিষিদ্ধ হয়ে যাবে, প্রিয়তমা।

ভয় নেই আমি এমন ব্যবস্থা করবো মুদ্রাস্ফীতি কমে গিয়ে বেড়ে যাবে
শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার সংখ্যা প্রতিদিন
আমি এমন ব্যবস্থা করবো গণরোষের বদলে
গণচুম্বনের ভয়ে
হন্তারকের হাত থেকে পড়ে যাবে ছুরি, প্রিয়তমা।

ভয় নেই,
আমি এমন ব্যবস্থা করবো
শীতের পার্কের ওপর বসন্তের সংগোপন আক্রমণের মতো
অ্যাকর্ডিয়ান বাজাতে-বাজাতে বিপ্লবীরা দাঁড়াবে শহরে,

ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
স্টেটব্যাংকে গিয়ে
গোলাপ কিম্বা চন্দ্রমল্লিকা ভাঙালে অন্তত চার লক্ষ টাকা পাওয়া যাবে
একটি বেলফুল দিলে চারটি কার্ডিগান।
ভয় নেই, ভয় নেই
ভয় নেই,
আমি এমন ব্যবস্থা করবো
নৌ, বিমান আর পদাতিক বাহিনী
কেবল তোমাকেই চতুর্দিক থেকে ঘিরে-ঘিরে
নিশিদিন অভিবাদন করবে, প্রিয়তমা।